Thursday, April 25, 2024

সেকশন

English
Dhaka Tribune

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অবস্থান পাল্টাচ্ছে মিয়ানমার?

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের কোনও রকম তোয়াক্কা না করে কিছুদিন আগে পর্যন্তও রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থান অব্যাহত রেখেছিল মিয়ানমার। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিচারের ব্যাপারে পদক্ষেপের সূচনা হওয়ার পর থেকেই মিয়ানমারের পূর্ববর্তী অবস্থান বদলাতে শুরু করে একটু একটু করে। ওই মাসেই প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা পরিষদকে রাখাইনে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। মে মাসে রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা আসে। ২ জুন প্রথমবারের মতো তারা সব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। ৮ জুন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সু চির বিরল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। একদিন পরে ৯ জুন ভারতের সঙ্গেই আলোচনা হয় একই ইস্যুতে। সু চির সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারেও মিয়ানমারের অবস্থান বদলের ইঙ্গিত মিলেছে। এদিকে হাতে পাওয়া এক বিশেষ নথির বরাতে এএফপি জানিয়েছে, বেসামরিক নিরাপত্তা, নিধনযজ্ঞে জড়িতদের বিচার এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে মিয়ানমারকে তাগিদ দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ। সবমিলে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের অবস্থান বদলের ইশারা মিলেছে।

আপডেট : ১০ জুন ২০১৮, ১২:০৭ এএম

গত বছর আগস্টে নিরাপত্তা চেকপোস্টে সন্ত্রাসী হামলার পর রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা-ধর্ষণ-ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও মানবাধিকার কমিশন শুরু থেকেই সোচ্চার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে। চীন-রাশিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও নিরাপত্তা পরিষদও সহিংসতার অবসান ঘটানো এবং রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধের তাগিদ দেয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালমার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইট ওয়াচসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রও সোচ্চার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সে দেশের সেনাবাহিনীর ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞাও আরোপ হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত অভিযোগকে বহুদিন আমলেই নেয়নি মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আর বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা স্যাটেলাইট ইমেজ আর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে হত্যা-ধর্ষণ-ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত তুলে আনলেও মিয়ানমার ওই অভিযোগকে অতিকথন কিংবা গুজব আখ্যায়িত করে উড়িয়ে দেয়। অন্যদিকেরাখাইনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ রাখে তারা।

রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের ঘটনায় আন্তর্জাতিক বিচার সম্ভব কিনাএপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পর্যবেক্ষণ জানতে চান ওই আদালতেরই একজন প্রসিকিউটর। একই  মাসের ৩০ তারিখে মিয়ানমার সফরে গিয়ে সু চি ও সেনাপ্রধানসহ দেশের সুশীল সমাজ ও ধর্মীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদল। সফর শেষে পরের মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেওয়া বিবৃতিতে নিরাপত্তা পরিষদ রাখাইনের মানবিক বিপর্যয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরে উদ্বেগ জানায়। দোষীদের বিচারসহ দ্রুত ও নিরাপদে স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে তৎপর হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয় বিবৃতিতে। একইমাসে রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা আসে নেপিদোর পক্ষ থেকে। ৮ জুন জাপানি এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের প্রসঙ্গে সু চি বলেনআমরা মনে করি তদন্ত কমিশনটি আমাদের পরামর্শও দিতে পারবেযা দীর্ঘ মেয়াদে রাখাইনে পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়ক হবে।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্রকখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদকখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ডকখনও আবার ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে। গত বছর ২৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও মিয়ানমার শুরু থেকেই তাদের বাঙালি মুসলিম আখ্যা দিয়ে নাগরিকত্ব অস্বীকার করে আসছে। তবে এবারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপ জোরালো হওয়ার এক পর্যায়ে প্রত্যাবাসন চুক্তিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকথিত বৈধ কাগজপত্রের অজুহাতসহ নানা কারণে প্রক্রিয়াটি এখনও বিলম্বিত করে যাচ্ছে মিয়ানমার। একজন রোহিঙ্গাও ওই চুক্তির আওতায় রাখাইনে ফিরেছে বলে জানা যায়নি। এমন বাস্তবতায় ৩০ মে তারিখে   মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধকে বিচারের আওতায় নিতে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আবেদন জানায় রোহিঙ্গাদের পক্ষের আইনজীবীরা।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেনাপ্রধানের সঙ্গে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির বৈঠক 

রোহিঙ্গা নিধনে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে কিনাসে বিষয়ে ২০ জুন নিজের অবস্থান জানাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। তবে জুনের শুরু থেকেই মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রশ্নে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। ২ জুন প্রথমবারের মতো নেপিদো সব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। সিঙ্গাপুরে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সম্মেলন শাংরি-লা সংলাপে মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাউং তুন প্রতিশ্রুতি দেনবাংলাদেশে পালিয়ে আসা ৭ লাখ রোহিঙ্গার সবাই যদি স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চায় তাহলে সবাইকে ফিরিয়ে নিতে রাজি মিয়ানমার। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জাতিগত নিধনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও সেখানে কিছু মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে বলে স্বীকারোক্তি দেন। গত ৭ জুন নেপিদোতে   জাপানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আশাহি শিমবুনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সু চি বলেনরোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা নিতে সম্মত তার দেশ। আইন বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন বিদেশি পরামর্শকদের সহায়তা নিতে আপত্তি নেই মিয়ানমারের। সাক্ষাৎকারে সু চি প্রতিশ্রুতি দেনবাংলাদেশ-মিয়ানমার সমঝোতার ভিত্তিতেই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন উৎসাহিত করার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। শুক্রবার (৮ জুন) রাজধানী নেপিদোতে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আবারও বৈঠক করেছে মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকারের সামরিক ও বেসামরিক শীর্ষ প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি ও সেনাপ্রধান মিং অং হ্লাংসহ উভয়পক্ষের ১৫ জন উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি জাতীয় নিরাপত্তাসহ রোহিঙ্গা সংকটের অভ্যন্তরীণ তদন্ত নিয়ে আলোচনা করেন। একদিন পর ভারত-মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ের ১৭তম দ্বিপাক্ষীক বৈঠকে অন্যান্য ইস্যুর সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ আলোচ্য ছিল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পদক্ষেপের পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিষদের অবস্থানও মিয়ানমারের অবস্থান বদলে ভূমিকা রেখেছে বলে আভাস পাওয়া গেছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি শনিবারের এক বিশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছেনিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে পাঠানো একটি চিঠির অনুলিপি তাদের হাতে এসেছে। ওই চিঠিতে সংকট নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েনিরপেক্ষ তদন্তে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ ও আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও নাগরিকত্ব নিশ্চিতের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

About

Popular Links