নানা আয়োজনে দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতানের (এস এম সুলতানের) ৯৫তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে।
এ উপলক্ষে নিজ জেলা নড়াইলে শনিবার (১০ আগস্ট) সকাল থেকে দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই শিল্পীকে স্মরণ করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন ও এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের আয়োজনে আজ সকালে সুলতান সংগ্রহশালা চত্বরে শিল্পীর মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, জিয়ারত, দোয়া মাহফিল, কোরআনখানি, শিশুদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন, এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন, নড়াইল প্রেসক্লাব, এস এম সুলতান বেঙ্গল চারুুকলা মহাবিদ্যালয়, লাল বাউল সম্প্রদায়, গ্রেভ শিল্পী গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সমাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শিল্পীর সমাধিতে পুস্পমাল্য অর্পণ করা হয়।
এসব কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইয়ারুল ইসলাম, নড়াইলপ্রেসক্লাবের সভাপতি এনামুল কবির টুকু,জেলা পরিষদ সদস্য রওশন আরা কবীর,মুক্তিযোদ্ধা সাইফুর রহমান হিলু, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজিম উদ্দিনসহ সুলতানপ্রেমীরা। এছাড়া চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় শিশুরা অংশগ্রহণ করে।
বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ায় বাবা মেছের আলী ও মা মাজু বিবির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনের শুরুতে ১৯২৮ সালে ভর্তি হন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে। স্কুলের অবসরে রাজমিস্ত্রি বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতেন শেখ মোহাম্মদ সুলতান। এ সময়েই ছবি আঁকায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। সুলতানের আঁকা সেই সব ছবি আর্কষণ করে তৎকালীন স্থানীয় জমিদারদের দৃষ্টি।
নড়াইলের জমিদার ব্যারিস্টার ধীরেন রায়ের আমন্ত্রণে ১৯৩৩ সালে রাজনীতিক ও জমিদার শ্যামাপ্রাসাদ মুখোপাধ্যায় ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে যান। সেখান তাঁর একটি প্রতিকৃতি (পোট্রেট) এঁকে শ্যামাপ্রাসাদসহ অন্যদেরও মুগ্ধ করে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সুলতান।
এরপর লেখাপড়া ছেড়ে ১৯৩৮ সালে কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা ও জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন সুলতান। সে সময় তাঁর পরিচয় হয় চিত্র সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে। সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান সুলতান।
১৯৪৩ মতান্তরে ’৪৪ সালে আর্ট স্কুল ত্যাগ করে ঘুরে বেড়ান এখানে-সেখানে। এরপর জীবনের নানা চরাই-উৎরাই পেরিয়ে এবং সংগ্রামী জীবনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছেন।
বাংলার কৃষক, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমার, মাঠ, নদী, হাওর, বাঁওড়, জঙ্গল, সবুজ প্রান্তর ইত্যাদি সুলতানের শিল্পকর্মের বিষয় ছিল। তার রঙ তুলিতে দারিদ্র-ক্লিষ্ট ও খেটে খাওয়া মানুষগুলো হয়েছেন পেশিবহুল। শ্রমজীবী মানুষগুলো হয়েছেন শক্তিশালী ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী।
চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি বাঁশি বাজাতে পটু ছিলেন এই গুণী শিল্পী। সাপ, ভালুক, বানর, খরগোশ, মদনটাক, ময়না, গিনিপিক, মুনিয়া, ষাঁড়সহ বিভিন্ন প্রাণী ছিল তার পোষা প্রাণীর তালিকায়।
চিত্রশিল্পের খ্যাতি হিসেবে পেয়েছে ভূয়সী প্রশংসা আর পুরষ্কার। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কারে তাকে নানা সময় ভূষিত করা হয়।
১৯৮২ সালে একুশে পদকসহ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদকেও ভূষিত হন তিনি।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননায় ভূষিত হন এস এম সুলতান।
অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর নড়াইলে প্রিয় জন্মভূমিতে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।