Tuesday, March 18, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

অবহেলায় ধ্বংসের পথে খুলনার ‘জল্লাদখানা’

বাডিটার দেওয়ালে বট, অশ্বথ ও আগাছার প্রাচুর্য, ছাদের সর্বত্র কড়ি বরগা ও টালি জংধরা এবং ভগ্নদশাগ্রস্ত। বাড়িতে কেউ বসবাস করে না অথচ দোতালার ছাদে উঁচু ট্যাপ থেকে জোরালোভাবে পানি পড়ছে

আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:২১ পিএম

সংস্কারের অভাবে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে খুলনায় “ভুতের বাড়ি” হিসেবে পরিচিত একাত্তরের ভয়ংকর জল্লাদখানা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকারদের ক্যাম্প ও ঐতিহাসিক এই বাড়িটি অযত্ন-অবহেলায় ঝোপ-ঝাড়ে পরিণত হয়েছে। খসে পড়ছে ভবনের ভেতরের অংশের পলেস্তারা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের স্বাক্ষী এই বাড়িটি সুরক্ষার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর টুটপাড়ার কবর স্থানের পূর্ব পাশে প্রায় শত বছর আগে এই বাগানবাড়ি নির্মাণ করেন তৎকালীন জমিদার দীননাথ সিংহ। ওই সময় এ বাড়িতে একজন তরুণীসহ পরপর কয়েকজনের অপঘাতে মৃত্যু হয়। ফলে বাড়িটি ভুতুরে ভেবে তা পরিত্যক্ত হয়। এরপর থেকে বাড়িটাকে সবাই “ভূতের বাড়ি” বলে আখ্যা দেন। একপর্যায়ে বাড়িটিতে আনসার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এখানেই গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম রাজাকার ক্যাম্প।

বাড়িটির সর্বত্রই আগাছার দখলে। ঢাকা ট্রিবিউন

খুলনার নাগরিক নেতা হুমায়ুন কবীর ববি বাড়িটি সম্পর্কে জানান, “একাত্তরে বাড়িটিতে হানাদার আর্মিদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে জামায়াতে ইসলামী, তাদের ছাত্র, যুব ও শ্রমিক ফ্রন্টের যুবকদের নিয়ে এখানে সর্বপ্রথম রাজাকার ট্রেনিং শুরু করে। পরবর্তীতে এই কুখ্যাত ক্যাম্পে পাকিস্তানপন্থী সকল দলের লোকদেরও ট্রেনিং দেওয়া হয়। এরা খুলনা ও খুলনার পার্শ্ববর্তী সকল হিন্দু ও আওয়ামী লীগ প্রভাবিত গ্রামগুলোতে হানাদার আর্মি ও তাদের দোসরদের নিয়ে মহাত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ, মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া ও চাঁদাবাজীসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করতো না। এই ক্যাম্পে প্রতিদিন শত শত যুবকদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করা হতো। রাতে ক্যাম্পের গেটে এসে দাঁড়াতো অভিশপ্ত এক কালো কভার্ডভ্যান। মৃত ও আধমরা হতভাগ্যদের বাড়ি পাঠানোর নাম করে উঠানো সেই এই ভ্যানে। তারপর তদের গল্লামারী (জায়গার নাম) নিয়ে গুলি বা জবাই করে ফেলে দেওয়া হতো নদীতে, খালে অথবা বিলে। এই ভূতের বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, জামায়াত ও মুসলিম লীগসহ দক্ষিণপন্থী দলগুলোর হাজারো কুকীর্তির স্বাক্ষী।”

বটের শেকড় দেওয়ালে ফাটলের সৃষ্টি করছে। ঢাকা ট্রিবিউন

আবু জাফর, মনোয়ার আলী, তকিম আহমেদসহ স্থানীয়রা জানান, বাড়িটি এখন ধ্বংসের মুখে। সামনে থেকে লোক দেখানোর জন্য বাড়িটাকে কিছুটা পলিশ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু পেছন দিক ও ভেতরের অবস্থা ভয়াবহ। বাড়িটি আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে আছে। কিন্তু শতবর্ষের স্থাপনা ও মুক্তিযুদ্ধকালের দুঃসহ স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং বাড়িটিকে ধ্বংস করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে।

সরেজমিনে বাড়িটির সামনের অংশ দেখে ধারণা হয়, বাড়িটা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বাডিটার দেওয়ালে বট, অশ্বথ ও আগাছার প্রাচুর্য, ছাদের সর্বত্র কড়ি বরগা ও টালি জংধরা ও ভগ্নদশাগ্রস্ত। বাড়িতে কেউ বসবাস করে না অথচ দোতালার ছাদে উঁচু ট্যাপ থেকে জোরালোভাবে পানি পড়ছে। সরু ধারায় সে পানি দোতলা থেকে পিছন দিকে মাটিতে পড়ছে। ফলে দোতালার ছাদে সবসময় পানি জমে থাকে। ঘরের মেঝে ভাঙ্গাচোরা, ভিজে স্যাঁতসেঁতে ও নোংরা। ভবনের নিচের একটি কক্ষে আনসার ভিডিপির গোডাউন রয়েছে।

সামনের অংশ চকচকে হলেও ভেতরের চিত্র ঠিক উল্টো। ঢাকা ট্রিবিউন

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড়িটির দোতলার একটি কক্ষে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আনসার সদস্যরা থাকতেন। তবে বর্তমানে ভবনটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত। খুলনার নাগরিক নেতাদের দাবি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও কালের স্বাক্ষী বাড়িটিকে যথাযথ মর্যাদায় টিকিয়ে রাখা হোক।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও খুলনা জেলা সাধারণ সম্পাদক মহেন্দ্রনাথ সেন বলেন, “খুলনার এই ‘ভুতের বাড়ি’টি ৭১ সালে ছিল খুলনা অঞ্চলের প্রথম রাজাকার ক্যাম্প। এ ভবনটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অন্যতম একটি স্থান। যা বর্তমানে আনসারদের নিয়ন্ত্রণে সংস্কারহীন অবস্থায় রয়েছে। এ ভবনটি সংস্কার ও যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা জরুরি।”

আনসার ভিডিপি খুলনা রেঞ্জের পরিচালক মোল্লা আমজাদ হোসেন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “ভবনটি পিডাব্লিউডি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। এখন আমাদের তেমন কোনো বাজেট না থাকায় এটি সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না। আর সংরক্ষণ বা মেরামতের জন্য সরকারেরও কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়নি। আর কোন দফতরে এ ভবনটি সংরক্ষণ করার বিষয়ে আবেদন করা যাবে সেটাও বুঝতে পারছি না।”

   

About

Popular Links

x