গত বছর পৃথক পাঁচটি ঘটনায় পাচার হতে যাওয়া ছয়টি বনরুই উদ্ধার করেছে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। প্রত্যেকটি বনরুই-ই পাচারের উদ্দেশে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী আইনে বনরুইকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাণীটি এতোটাই হুমকির সম্মুখীন যে, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) বনরুইকে লাল তালিকায় স্থান দিয়েছে।
গবেষকদের মতে, আশু পদক্ষেপ না নিলে এই বন্যপ্রাণীটি অচিরেই বাংলাদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে।
বাংলাদেশে বনরুই
বনরুই (Pangolin) আঁশযুক্ত একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী। পৃথিবীর ৮ প্রজাতির বনরুইয়ের মধ্যে বাংলাদেশে তিনটির অস্তিত্ব ছিল। বর্তমানে কেবল ভারতীয় বনরুই (Indian Pangolin) ও চায়না বনরুই (Chinese Pangolin) পাওয়া যায়। এশীয় বৃহৎ বনরুই (Asian Giant Pangolin) নামে অপর একটি বনরুই চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন - শকুন সংরক্ষণে বাংলাদেশ, কী করছে সরকার?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, “পিঁপড়াভুক এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি বাংলাদেশে মহাবিপন্ন। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ও উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় অল্পসংখ্যক বনরুই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে।”
মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বনরুই। ছবি: Polls২০১৭ সালে Creative Conservation Alliance in Dhaka এর একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেশে বনরুই কমে যাওয়ার উদাহরণ হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলের একজন বনরুই শিকারির বরাত দিয়ে বলা হয়, ২০১০ সালে তিনি যেখানে ৩২টি বনরুই শিকার করেছিলেন সেখানে ২০১৪ সালে মাত্র দুটি বনরুই শিকার করতে পেরেছিলেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৪ সালে পার্বত্য বনভূমিতে বনরুইয়ের ঘনত্ব পর্যবেক্ষণে ক্যামেরা ফাঁদের মাধ্যমে ১৬ হাজার ছবি তোলা হয়। সেখানে ১৯টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর উপস্থিতি প্রমাণিত হলেও বনরুইয়ের কোনো ছবি পাওয়া যায়নি। যা ওই বনাঞ্চল থেকে প্রাণীটি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া বা বিলুপ্ত হওয়ার লক্ষণ।
সারা বিশ্বে পাচারের শীর্ষে
বন্যপ্রাণী পাচারের ওপর নজরদারি করা বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা “ট্রাফিক” এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে যত প্রকার স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণী রয়েছে তারমধ্যে মধ্যে বনরুই সবচেয়ে বেশি পাচারের শিকার হয়।
২০১০-২০১৫ সাল পর্যন্ত বনরুই ও তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারের চিত্র। ছবি: traffic.orgপ্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ টন বনরুইয়ের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার হয়। এরমধ্যে বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে গত ১৬ বছরে অন্তত ১৬ লাখ বনরুই পাচারের ঘটনা ঘটেছে। যা বন্যপ্রাণী পাচারের সংখ্যার দিক দিয়ে সবার শীর্ষে।
২০১৬ সালে সাইটিসের কপ (CITES Conference of Parties) সম্মেলনে আইইউসিএন এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত, শুধু এই তিন বছরেই বিশ্বব্যাপী পাঁচ লাখ বনরুই পাচারের শিকার হয়েছে।
চোরাকারবারীদের পছন্দ বাংলাদেশ?
২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৬ বছর নজরদারি, গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে “ট্রাফিক” জানতে পারে, শিকার ও পাচারের জন্য ৬৭টি দেশের ১৫৯টি রুট বেছে নিয়েছে পাচারকারীরা।
মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বনরুই। আদনান আজাদ আসিফচীন ও ভিয়েতনাম বনরুইয়ের প্রধান ক্রেতা হওয়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে ব্যবহার করেই দেশ দুটিতে প্রাণীটি পাচার করা হচ্ছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ দেশগুলোর ক্ষেত্রে বনরুই সরাসরি চীন-ভিয়েতনামে পৌঁছালেও ভারতের বনরুই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমারের মাধ্যমে চীন বা ভিয়েতনামে যাচ্ছে, ট্রাফিকের গবেষণা প্রতিবেদনে তেমনটিই উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন - বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে বাংলাদেশ কি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে?
১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছর ধরে “সাইটিস” (বিলুপ্ত নয় এমন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী রপ্তানিতে দেওয়া সনদ) এর প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আইইউসিএন জানায়, বনরুই পাচারকারীরা বিশ্বব্যাপী ২১৮টি রুট ব্যবহার করে। সাইটিসের তথ্যেও বাংলাদেশকে বনরুই পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সীমান্তে যথাযথ নজরদারির অভাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহজে “ম্যানেজ” করতে পারার কারণেই রুট হিসেব বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে পাচারকারীরা, এমনটিই মনে করেন বন্যপ্রাণী গবেষকেরা।
বনরুই পাচারের রুট। ছবি: traffic.orgএ বিষয়ে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আস সাদিক ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “গত বছর শুধু উত্তরবঙ্গ থেকেই চারটি বনরুই উদ্ধার করা হয়েছে, আরও একটি বনরুই একই এলাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, তাই আমরা ধারণা করছি উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোই বনরুই পাচারের অন্যতম রুট।”
বনরুই পাচার ঠেকাতে সরকারের পদক্ষেপ কি যথাযথ?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বনরুই রক্ষায় বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরি হলেও চোরাই বাজারে বিপুল চাহিদা থাকায় প্রাণীটিকে হত্যা ও পাচারের হাত থেকে রক্ষা করা দুষ্কর হয়ে পড়ছে। বনরুই রক্ষায় বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ নিয়েছে জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক জহির আকন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “যে কোনো বন্যপ্রাণী পাচাররোধে অপরাধ দমন ইউনিট সতর্ক রয়েছে। যেসব রুট দিয়ে বনরুই পাচার হচ্ছে, সেটি আমরা চিহ্নিত করেছি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ওই এলাকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। তারাও এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন।”
আরও পড়ুন - প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে খাঁচার পাখি অবমুক্ত করে সমালোচনায় মেয়র খোকন
বনরুই সংরক্ষণ ও সংখ্যা বৃদ্ধিতে বন বিভাগ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ বন সংরক্ষক (অর্থ ও প্রশাসন) মিহির কুমার দো ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “শুধু বাঘ ও হাতি সংরক্ষণের জন্য কেবল আলাদা কর্মসূচি বা প্রকল্প রয়েছে। অন্যকোনো প্রাণীর জন্য আলাদা কর্মসূচি নেই। তবে এই প্রাণীটি সংরক্ষণে আমরা সচেতন রয়েছি।”
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের সদস্যরা একটি বনরুই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করছে। ছবি: সৌজন্যশুধু সচেতনতা দিয়েই কেবল একটি মহাবিপন্ন প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা সম্ভব কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মিহির কুমার দো বলেন, “বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকল্পে যে লোকবল, প্রযুক্তি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সহায়তা প্রয়োজন, তা আমাদের নেই।”
তবে কম জনবল ও অপর্যাপ্ত অর্থ দিয়েই এ বন্যপ্রাণীটি সংরক্ষণ করা সম্ভব বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান।
ঢাকা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, “এটা ঠিক আমাদের (বাংলাদেশ) অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরও শুধু একটি পদক্ষেপের মাধ্যমেই বনরুইকে রক্ষা সম্ভব বলে আমি মনে করি। সেটি হচ্ছে, যতগুলো সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে সেগুলোতে মানুষের অনু্প্রবেশ শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। তাহলে প্রাণীটি শিকার ও পাচারের সুযোগ থাকবে না। আর এতে শুধু বনরুই-ই নয়, বিপন্ন অন্যান্য বন্যপ্রাণীও রক্ষা পাবে এবং একই সাথে বন ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হবে।”
আরও পড়ুন - বাঘ বেড়েছে সুন্দরবনে