মাত্র দু’লাখ টাকা আদমকারবারির হাতে গুঁজে দিলেই একনিমিষে পৌঁছানো যায় ইউরোপের দরজায়। আর সেটিই অগণিত বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীর আজীবন লালিত স্বপ্ন।
লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব ও বিভিন্ন দেশের অভিবাসন আইনগুলো কোটি কোটি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে এক অমোঘ আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় চরম বিপজ্জনক সেই পথে। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনসহ আরও কয়েকটি দেশে বছরের পর বছর ধরে চলমান সংঘর্ষ, কেবল সেখানকার অধিবাসীদেরেই নয় বরং সেসব দেশে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকদেরকেও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত করে তোলে।
গত কয়েকবছর যাবতই, মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে ভূমধ্যসাগর পার হওয়ার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। চলমান অস্থির ও অনিশ্চিত জীবনের চেয়ে একটি নিরাপদ ও নিশ্চিত জীবনের অলীক কল্পনায় তারা পাড়ি জমান বিপদসঙ্কুল এসব পথে। যদিও, এরমধ্যে এমন অনেকের ভাগ্যেই মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।
হিসেবমতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে ৪,০৩৬টি মরদেহ ফিরিয়ে এনেছে। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই ৩৩,১১২জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে মৃত অবস্থায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো।
এছাড়া কেবল ২০১৬ সালেই, ৩৪ হাজার অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশী দক্ষিণ এশিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে। সেসময় ইতালি কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে দেশটিতে পৌঁছানো ৮,১৩১ বাংলাদেশির তথ্য নিবন্ধন করেছে। এরপর ২০১৭ সালের প্রথম ১০০দিনের মধ্যেই, ইতালি তাদের বন্দরে আরও ৪,৬৪৫ বাংলাদেশিকে খুঁজে পায়।
কেবল ব্যক্তিই নয়, ভুক্তভোগী পরিবারগুলোও
সুনামগঞ্জের আলাল মিয়া থাকেন ওমানে। একটু সুখ ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের আশায় তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য সামান্য যে জমি-জমা ছিলো সব বিক্রি করে দেয় তার পরিবার। তবে, ওমানে যাওয়ার পরও আলাল মিয়া পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে পারেননি। প্রতিমাসে খুব সামান্য পরিমাণ টাকাই বাড়িতে পাঠাতে পারতেন তিনি।
প্রায় ১২বছর পর গত বছরের নভেম্বরে নিজের দুর্দশাগ্রস্ত প্রবাসজীবনের কথা পরিবারকে ফোন করে জানান তিনি। তার কথা ছিলো, “মাস্কটে আমি খুবই সমস্যার মধ্যে আছি। এসব সমাধান করার মতো রোজগারও আমি করি না। তোমরা যদি দালালকে সোয়া দুইলাখ টাকা দিতে পারো, তাহলে আমাকে সে ইউরোপে পাঠাতে পারবে। তখন আমি অনেক কামাই করে তোমাদের বেশি করে টাকা পাঠাতে পারবো।”
ভূমধ্যসাগরের লিবীয় উপকূল থেকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ৬৫ অভিবাসপ্রত্যাশীকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি উদ্ধার করে একটি স্প্যানিশ এনজিও এএফপি
পরের মাসেই বড়ভাই কিরণ মিয়া তার কথা মতো বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেন। নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে পরিবারটি তাদের অবশিষ্ট ভিটে-মাটির সবকিছুই বিক্রি দিয়েছিলো।
তবে গত ২৬ ডিসেম্বর যখন আলাল মিয়া নৌকায় চড়ে ইউরোপের উদ্দেশে রওনা দেন, বড় বড় ঢেউ এসে তাদের নৌকাটিকে ডুবিয়ে দেয়।
আর এরসাথেই একটি পরিবারের আশা-ভরসা-স্বপ্ন সবকিছুরই সলিল সমাধি ঘটে। মাসখানেক পর আলাল মিয়ার মরদেহ দেশে পৌঁছায়।
স্বপ্ন, প্রতারণা ও মৃত্যু
১৫ বাংলাদেশিসহ মোট ৫০জনের একটি দলের সঙ্গে রাতেরবেলায় ওমান উপসাগর একটি নৌকায় অবৈধভাবে ইরান পার হয়েছিলেন আরেক অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশি সৈয়দ ফয়সাল আহমেদ। এরপর মরুভূমির মধ্যে ক্ষুৎপিপাসায় মৃতপ্রায় অবস্থায় ধুঁকেধুঁকে অবশেষে তিনদিন পর ইরান-তুরস্ক সীমান্তে এসে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
তিনি ওমানের মাস্কটে ৯ বছর কাটিয়েছেন। তার স্ত্রী ও একছেলে-মেয়ে সিলেটের বালাগঞ্জে থাকেন। তার ভাই শরিফ অসংখ্যবার মাস্কটের বাংলাদেশি এক দালালের সাথে যোগাযোগ করেছেন। সে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছে, ফয়সাল ইরান ও তুরস্ক হয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়াই ইউরোপে চলে যেতে পারবে।
শরিফ জানান, “আমি তাৎক্ষণিকভাবে ৩০ হাজার টাকা পাঠিয়েছি। যখন সে আমার ভাইকে ভালোভাবে ওমান থেকে ইরান পর্যন্ত নিয়ে আসে আমি ইউরোপ যাওয়ার খরচ বাবদ আরও ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা তাকে পাঠাই। আমরা ওই দালালের ফোন থেকে আমার ভাইয়ের সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা বলেছি। যখন তারা ইউরোপে পৌঁছায়, তখন দালাল আমাদের বলে আরও ২ হাজার ইউরো পাঠাতে হবে। শুনে আমরা হতবাক হয়ে যাই। কারণ, এইকথা তো আমাদের আগে বলা হয়নি। আর তাছাড়া, আমরা আমাদের যা ছিলো তার সবই তো দিয়েছিলাম। টাকা-পয়সা নিয়ে অনেক দরকষাকষি হয়, শেষপর্যন্ত সবকিছু চিন্তা করে আমাদেরকেই নরম হতে হয়।”
“তবে, খুব তাড়াতাড়িই তারা আমাদের সাথে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এর অল্প কয়েকদিন পরেই জানতে পারি আমার ভাই আর বেঁচে নেই। আমি জানি না ওই দালাল কে বা কারা ছিলো। তবে আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করবো, এরকম দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যেন এরা আমাদের মত মানুষকে আর নিঃস্ব বানাতে না পারে।”
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ
সরকারের ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড (ডব্লিউইডব্লিউবি) বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি তদারকি করে থাকে।
তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা সরকারিভাবে ২০১৯ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে ৪,০৩৬জন শ্রমিকের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে এনেছে। তবে তুরস্ক থেকে কোনও মরদেহ আনা হয়নি, কেননা তুরস্কে সরকারিভাবে কোনও শ্রমিক পাঠানো হয় না।
কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, তুরস্ক হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে যেতে চাওয়া শ্রমিকদের কখনই বৈধতা দেওয়া হয় না। তারা মারা গেলে বা আটক হলে সেক্ষেত্রে তার নিজের বা পরিবারের ব্যবস্থায় ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী সুরক্ষানীতি অনুসারে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি কোনও বাংলাদেশি নাগরিককে আটকে রাখার সময় তা বাংলাদেশকে অবহিত করে। পুলিশ তখন তাদের পরিচয় সনাক্ত করে থাকে।
বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা, বলেন, অবৈধভাবে তুরস্ক বা অন্যদেশে পৌঁছানোর পর বেশিরভাগই তাদের পাসপোর্টটি নষ্ট করে ফেলেন। একারণেই অনেকক্ষেত্রে তাদের পরিচয় সনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
পুলিশ ও দূতাবাস কর্মকর্তারা জানান, আদমপাচারের দুইরকম ধরণ আছে। প্রথমটি, মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত শ্রমিকদের ইউরোপে যাওয়ার জন্য টোপ ফেলা। আর অন্যটি, বাংলাদেশে থাকা তরুণদের তুরস্ক ও লিবিয়া হয়ে ইউরোপে পাঠানোর লোভ দেখানো।
তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, তুরস্কের বর্তমান সরকার ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশী ঠেকানো সম্পর্কিত চুক্তিস্বাক্ষরের পর থেকে তাদের সীমান্তে নিরাপত্তা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত এম আল্লামা সিদ্দিকি ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, পাচারকারীদের মাধ্যমে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে গিয়ে ধরা পড়েছে কমপক্ষে ৩৫০জন বাংলাদেশি। বর্তমানে তারা তুরস্কের কারাগারে আছে।
কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বড় শঙ্কা, আটককৃত ব্যক্তিটি ইসলামিক স্টেট (আইএস) সদস্য বা অন্যকোনো নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য কিনা? এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটি তিনমাস পর্যন্ত সময় নেয় এবং তখনই তাদের মুক্তি দেওয়া হয় যখন আটককেন্দ্রগুলো একবারে ভর্তি হয়ে যায়।
তবে, মুক্ত হওয়ামাত্রই অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীরা গ্রিস বা ইতালিতে পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।