ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিন নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় মৃত্যু শয্যায় শুয়ে আছেন মোহাম্মদ সুলতান। তাকে শেষবারের মতো দেখতে বারান্দায় ভিড় জমাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। তাদের কারো চোখে জল, কেউ ছাড়ছেন দীর্ঘশ্বাস। এমনই এক মুহূর্তে চলে গেলেন মোহাম্মদ সুলতান। ঘটনাটা ১৯৮৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু কে এই সুলতান ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি ওয়ার্ডের বেডেও যার ঠাঁই হয়নি?
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ১১ জন ছাত্র প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন তাদের একজন মোহাম্মদ সুলতান। তিনিই প্রথম বারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের জন্যই জেলে গেছেন একাধিকবার। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য, গণমানুষের পক্ষে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মহান এই ভাষা সৈনিকের মৃত্যু হয়েছিল চরম অনাদর-অবহেলায়।
আবার ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি পাননি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এখন পর্যন্ত নির্মিত হয়নি তার কোনো মূর্যাল। পালিত হয় না তার জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী, আয়োজন হয় না কোনো আলোচনা সভার। তবে শুধু পরিবারের সদস্যরাই প্রতিবছর দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। মোট কথা, কোনো এক রহস্যজনক কারণে মোহাম্মদ সুলতান চলে গেছেন বিস্মৃতির অতল গহ্বরে।
যদিও ২০০৭ সালে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়কটিকে “ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক” নামকরণ এবং ২০১৩ সালে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন পক্ষ থেকে জেলার কৃতি সন্তান মোহাম্মদ সুলতানকে মরনোত্তর সম্মাননা দিয়ে ইতিহাসের দায় সারা হয়েছে।
বাবা মায়ের আট সন্তানের মধ্যে পঞ্চম মোহাম্মদ সুলতান জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর পঞ্চগড় জেলার (তৎকালীন দিনাজপুর জেলা) বোদা উপজেলার মাঝগ্রামে। যশোর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা, রাজশাহী সরকারি কলেজে স্নাতক ডিগ্রী, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতোকত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন সুলতান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যখন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন মোহাম্মদ সুলতানসহ ১১জন ছাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন।
মোহাম্মদ সুলতান কৈশোরেই “ভারত ছাড়” বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সুলতান প্রথম আকৃষ্ট হন রাজনীতিতে। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে ১৯৪৮ সালে রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন এবং ছাত্র আন্দোলনে মোহাম্মদ সুলতান অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন। ১৯৫১ সালে যুবলীগে যোগ দেন এবং যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ভাষা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের শেষের দিকে ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হয়। মোহাম্মদ সুলতান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা ও প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক কাজে গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে শহরে ঘুরেছেন। প্রগতিশীল ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করেছেন। এ জন্য বহুদিন মোহাম্মদ সুলতানকে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এই একই সময়ে তিনি যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতানের গ্রামের বাড়ি। ঢাকা ট্রিবিউন১৯৫৬ সালে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ইমাদুল্লাহ লোকান্তরের পর মোহাম্মদ সুলতান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৭ সালে ন্যাপের জন্মলগ্নেই তিনি ন্যাপ প্রাদেশিক কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ বিভক্তির পর মোহাম্মদ সুলতান মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাপের প্রাদেশিক কমিটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সুলতান বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং আন্দোলনের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করে রাখার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। ভাষা আন্দোলনের পর তিনি এম আর আখতার মুকুলের অংশীদারিত্বে প্রধানত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র “পুঁথিপত্র” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সংকলন “একুশে ফেব্রুয়ারি” প্রকাশ করেন।
রাজনৈতিক কারণে মোহাম্মদ সুলতানকে দীর্ঘদিন কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে হয় এবং আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হয়। ১৯৫৪ সালে মোহাম্মদ সুলতানকে বিনা বিচারে ১ বছর কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। এরপর ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোহাম্মদ সুলতান আবারও গ্রেফতার হন এবং সামরিক সরকারের অধীনে প্রায় ৪ বছর বিনা বিচারে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে আটক থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় পাকিস্তান সরকার মোহাম্মদ সুলতানের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করলে মোহাম্মদ সুলতানকে আত্মগোপন করে রাজনৈতিক সংগঠনের কাজ চালাতে হয়। কিন্তু কারাবাসকালে, আত্মগোপন জীবনে, কী শিক্ষকতার জীবনে (ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুল) কী সাংবাদিকতার জীবনে সবসময়ে মোহাম্মদ সুলতান প্রগতিশীল পুস্তক প্রকাশনার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন এবং নিজের শেষ সম্বলটুকু দিয়েও প্রগতিশীল পুস্তক প্রকাশনার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।
অবশ্য এ বিষয়ে তাকে যিনি নীরবে তিলেতিলে সাহায্য করে গেছেন তিনি হলেন তার স্ত্রী নুরজাহান সুলতান নোরা। কিন্তু ১৯৭৮ সালে নোরার মৃত্যুর পর সহিষ্ণুতা-ধৈর্যের পাহাড়ে ফাটল ধরে। সুলতানের অটুট স্বাস্থ্যে ভাঙ্গন ধরে। তিনি ক্রমশঃ ক্ষয় হতে থাকেন। এতদসত্বেও মোহাম্মদ সুলতান রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে প্রকাশনার দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি। উপরন্তু পুস্তক প্রকাশকদের সংগঠিত করে দেশে সৃজনশীল ও প্রগতিশীল সাহিত্য পুস্তক প্রকাশনার জন্য এক গঠনমূলক আন্দোলন শুরু করেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মোহাম্মদ সুলতান বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক সমিতির সহ-সভাপতি এবং বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য ছিলেন।
চলে যাওয়ার সুলতানের এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে, এক মেয়ে ও দুই ছেলে তখনো অপ্রাপ্তবয়স্ক। এদের জন্য এক কানাকড়িও রেখে যেতে পারেননি। সারাজীবন সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন লালন করেছেন তিনি কিন্তু সেই সমাজ তিনি দেখে যেতে পারেননি।
বিপ্লবের স্বপ্নকে লালন করতে গিয়েই তিনি একবারও ভাবেননি, কীভাবে কঠিন জীবনকে মোকাবেলা করবে তার সন্তানেরা। মোহাম্মদ সুলতানকে সমাহিত করা হয় ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে। স্ত্রী নূরজাহান সুলতানের কবরের পাশেই তিনি শায়িত হন চিরনিদ্রায়। কিন্তু সেই কবরের জায়গা কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা ছিল না পরিবারের সদস্যদের কাছে। সুলতানের পরিবারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কবরের টাকা দেওয়ার পরই গোরখোদকদের কোদালগুলো নেমে আসতে থাকে মাটির ওপর।