কোনো কোনো চিকিৎসক প্রায় দুই মাস ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাসপাতালেই রয়েছেন
করোনাভাইরাস মহামারি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। এরই মধ্যে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চাঁদপুর ২৫০ শয্যার সরকারি জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের নিরলস চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন একদল চিকিৎসক। তারা ছাড়া এখানে চিকিৎসা সেবায় যুক্ত হয়েছেন চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষকরাও। হাসপাতালের রোস্টার অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
জানা যায়, চাঁদপুরে গত ২২ মে পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছে শতাধিক মানুষ। আক্রান্তদের বেশিরভাগই চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এসব রোগীকে সেবা দিতে চিকিৎসকরা একটানা ৭ দিন করে থাকছেন হাসপাতালে। এরপর থাকতে হচ্ছে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে। কোনো কোনো চিকিৎসক প্রায় দুই মাস ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাসপাতালেই রয়েছেন। চিকিৎসকদের পাশাপাশি নার্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সমানতালে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাই এমন সঙ্কটময় সময়ে জেলার অধিবাসীদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে হাসপাতালটি।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জামাল সালেহ উদ্দিনের নির্দেশনায় এই দুর্যোগকালে সদর হাসপাতালে চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছেন চাঁদপুর মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকরা। আর জেলার পুরো করোনা পরিস্থিতির সার্বিক বিষয় তদারকি করছেন সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্যাহ। সদর হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন অন্তত ৩০ জন চিকিৎসক।
হাসপাতালের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত সার্বিক সেবা কার্যক্রম তদারকি করছেন তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হাবিব-উল-করিম, বিএমএ সভাপতি ডা. এমএন হুদা, সহকারী পরিচালক ডা. একেএম মাহবুবুর রহমান। এছাড়া বিএমএ সেক্রেটারি ডা. মাহমুদুন নবী মাসুমও এই দুর্যোগকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
রোগীদের সেবায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগ এবং ফ্লু-কর্নার সামলাচ্ছেন আরএমও ডা. এএইচএম সুজাউদ্দৌলা রুবেল, ডা. মো. নুর-ই-আলম মজুমদার, আরএমও ডা. আসিবুল আহসান চৌধুরী, ডা. আনিছুর রহমান, ডা. নাজমুল হক, ডা. মো. মিজানুর রহমান, ডা. সৈয়দ আহমদ কাজল, ডা. মো. তৌহিদুল ইসলাম খান, ডা. মো. আনিসুর রহমান সুফি, ডা. আনিসুর রহমান ও ডা. মো. মাহবুব আলী খান।
দায়িত্বে নিয়োজিত চিকিৎসকরা জানান, করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে আইসোলেশন ওয়ার্ডে। ২২ মে পর্যন্ত হাসপাতালের আইসোলেশনে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬০ জন রোগী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং স্ত্রী-সন্তানদের থেকে আলাদা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাদের।
জানা যায়, পাঁচটি দলে তারা করোনাভাইরাসের চিকিৎসা অব্যাহত রেখেছেন। ৩ জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিটি দল একনাগাড়ে ৭ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৪ দিন তারা থাকেন কোয়ারেন্টাইনে। কোয়ারেন্টাইন শেষে আরও ৭ দিন বাসায় থাকার পর আবারও তারা ফিরে আসেন করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে।
জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী, প্রথম দলটিতে রয়েছেন সিনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) ডা. নাহিদ সুলতানা, সহকারী অধ্যাপক অর্থো-সার্জন ডা. মো. কামাল হোসেন, মেডিক্যাল কলেজের প্রভাষক ডা. আওলাদুজ্জামান।
দ্বিতীয় দলে রয়েছেন সিনিয়র কনসালট্যান্ট (ইএনটি) ডা. আহসান উল্যাহ, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (কার্ডিওলজি) ডা. মীর মো. মুনতাকিম হায়দার রুমি, সহকারী অধ্যাপক অর্থো-সার্জন ডা. মো. সাব্বির হোসেন।
তৃতীয় দলে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. আবু সালেহ মো. সিরাজুম মনীর, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (চর্ম ও যৌন) ডা. এসএম হাসিনুর রহমান, রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান ডা. মো. নোমান হোসেন।
চতুর্থ দলে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. মো. সাইফুল ইসলাম পাটওয়ারী, সহকারী অধ্যাপক (বায়োকেমিস্ট্রি) ডা. মো. খালেদ মোশারফ হোসেন ও ডা. মো. বাহারুল আজম ভূইয়া।
পঞ্চম দলে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক (সার্জারি) ডা. মো. হারুন-অর-রশিদ, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অ্যানেসথেসিয়া) ডা. মো. সাইফুল ইসলাম ও মেডিক্যাল কলেজের প্রভাষক (ফিজিওলজি) ডা. মো. হামিন মেহবুব।
চিকিৎসকরা জানান, করোনাভাইরাসে উপসর্গ নিয়ে কেউ জরুরি বিভাগে এলে তার নমুনা সংগ্রহ করে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। আর যাদের করোনাভাইরাসের লক্ষণ আছে, কিন্তু তারা হাঁটা-চলা করতে পারেন—এমন রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাসায় আলাদা থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরে মোবাইলে ফোনে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হয়। তবে। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার বিষয়টি সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা হয়।
সদর হাসপাতালের ডা. মো. নূর-ই-আলম মজুমদার বলেন, “আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমাদের পরিবার ছেড়ে হোটেলে থাকতে হচ্ছে। দুই মাস ধরে আমি নিজেও স্ত্রী-সন্তান থেকে আলাদা রয়েছি। এই সময়ে ডিউটি করা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হাবিব-উল-করিম বলেন, “করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর মার্চ থেকেই আমরা ২৪ বেডের আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত করি। এখন আইসোলেশন ইউনিটটি অনেক সুন্দর করা হয়েছে, যাতে রোগীরা আবাসনজনিত কোনও ধরনের সমস্যা অনুভব না করেন।”
সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, “এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। তারপরও যতটুকু সম্ভব নিরাপত্তা নিয়ে চলতে হবে। সদর হাসপাতালে আরও ১৩ জন চিকিৎসক শিগগিরই নিযুক্ত হবেন। তারা বর্তমানে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ট্রেনিং নিচ্ছেন।”
মতামত দিন