তাম্রফলকের ভাষ্যানুযায়ী, আনুমানিক ৯৩৫ সালে ২০০০ একর জমির ওপর চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল
প্রাচীন জনপদ শ্রীহট্টের (সিলেটের) মৌলভীবাজার জেলার জুড়ীতে কথিত চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্বের খোঁজে তিন দিনের অনুসন্ধানে গেছে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক (চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ) ড. মো. আতাউর রহমানের নেতৃত্বে রবিবার (২৬ জুলাই) দলটি দ্বিতীয় দিনের মতো অনুসন্ধানে চালায়।
চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিত্বের অনুসন্ধানের প্রথম দিনে কুলাউড়ার ঐতিহাসিক ভাটেরা তাম্রফলক এলাকা পরিদর্শন করে অনুসন্ধান ও মাঠ জরিপ করে পুরাকীর্তির আলামত সংগ্রহ করেন প্রতিনিধি দল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের কলিমাবাদ (সাত বাদশার টিলা/রাজার টিলা) এলাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক ভাটেরা তাম্রফলকের নিদর্শনের পুরাকীর্তি অনুসন্ধান ও মাঠ জরিপ শুরু হওয়ায় স্থানীয়দের মনে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সবাই মনে করছেন এই এলাকায় প্রাচীন রাজাদের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। এটা খনন ও অনুসন্ধান করলে হাজার বছরের পুরনো ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর আগে গত শনিবার (২৫ জুলাই) বিকেল ৫টা থেকে সন্ধা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ড. মো. আতাউর রহমানের নেতৃত্বে প্রত্নতাত্ত্বিক দলটি ভাটেরার রাজার টিলা এলাকায় ভাটেরা তাম্রফলক পরিদর্শন করে আলামত হিসেবে ইটের টুকরো, পাথর, পাতিল সংগ্রহ করে।
এ সময় স্থানীয় এলাকার বিভিন্ন লোকদের কাছ থেকে ওই টিলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। পরিদর্শন দলে রয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ফিল্ড অফিসার মো. শাহিন আলম, সহকারী কাস্টোডিয়ান হাফিজুর রহমান, গবেষণা সহকারী ওমর ফারুক, সার্ভেয়ার চাইথোয়াই মার্মা।
এর আগে গত ১৫ জুলাই “চন্দ্র বংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক স্থাপিত কথিত শ্রীহট্টের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরাকীর্তি সম্পর্কে সরেজমিন জরিপ ও পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রয়োজন” উল্লেখ করে সিলেট অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালককে চিঠি দিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আমিরুজ্জামান।
চিঠিতে কথিত বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরাকীর্তি অ্যান্টিকস অ্যাক্ট ১৯৬৮ অনুসারে সংরক্ষিত ঘোষণা ও সংস্কার-সংরক্ষণের কোনো সুযোগ আছে কিনা এ সম্পর্কে সরেজমিন পরিদর্শন পূর্বক আলোকচিত্র ও মতামতসহ প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিনিধি দলের প্রধান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তিন দিনের অনুসন্ধানের প্রথম দিনে ভাটেরা তাম্রফলক এলাকা থেকে প্রাচীন রাজাদের স্থাপনার কাজে ব্যবহৃত অনেক পুরাকীর্তির আলামত সংগ্রহ করেছি। এই টিলাটি ব্রিটিশ আমলে সংরক্ষণ করা হয় যা এখনো কালের সাক্ষী হয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে প্রাচীন রাজাদের বসবাসের ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। বর্তমানে অবাধে ওই এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি টিলা কাটার কারণে পুরাকীর্তির আলামত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ সময় তিনি আগামী শুষ্ক মৌসুমে এই তাম্রফলক এলাকা খনন কাজ করবেন বলে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ১৯০৪ সালের ৭ম আইন অনুসারে সংরক্ষিত এই কীর্তির কোনো অনিষ্ট বা প্রাচীন সৌন্দর্য নষ্ট করলে তিন মাসের জেল অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
প্রাচীন এই নিদর্শন সংরক্ষণে সকলকে সচেতন হওয়ার জন্য অনুরোধ করে ভাটেরা তাম্রফলকের পাশ থেকে অবাধে টিলা কাটা বন্ধ করার জন্য স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, জানা যায়, প্রাচীনকালে রাজ-রাজারা তামার পাত বা প্লেটে রাজকীয় ঘোষণা, অনুশাসন ইত্যাদি খোদাই করে রাখতেন। ভাটেরা তাম্রফলক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। ১৯১২ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ সময়ে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার নিধনপুরে ছয়খানা তাম্রফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো সপ্তম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ।
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরায় (রেলপথে মাইজগাঁও কুলাউড়ার মাঝামাঝি সাত রাজার টিলায়) পাওয়া গেছে দুইখানা তাম্রফলক। এগুলো একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। ছাড়া ১৯৬১ সালে মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলা থেকে একটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়।
এসব তাম্রফলকে চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজা শ্রীচন্দ্র সম্রাজ্যভুক্ত এলাকা ও শাসনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তার শাসনকাল ছিল ৯০৫-৯৫৫ সাল। তাম্রফলকের ভাষ্যানুযায়ী দশম শতকের প্রথম ভাগে (আনুমানিক ৯৩৫ সাল) রাজা চন্দ্র সিলেটে ৪০০ পাটক (২০০০ একর) জমিতে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়প্রতিষ্ঠা করেন। গবেষকরা অনুমান করেন যে, চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শাস্ত্রবিদ্যা অধ্যয়নের পাশাপাশি চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতিষবিদ্যা, শল্যবিদ্যা, ধাতু বিদ্যা, হেতু বিদ্যা, শব্দবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হতো।
মতামত দিন