‘যা আয় হয় তা দিয়ে কোনো রকমে টানাটানি করে চলে। কয়েকদিন আগে কিছু সাহায্যও পেয়েছি। কিন্তু স্থায়ী কোনো সুবিধা পাইনি। জীবন সংগ্রামে আমি এক পরাজিত সৈনিক’
এক সময় মাটির তৈরি তৈজসপত্র ছাড়া সংসার জীবনে চলাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াতো। কিন্তু শিল্প বিপ্লব ও ধাতুর তৈরি তৈজসপত্র মাটির তৈজসপত্রের চাহিদাকে প্রায় শূন্যের কোটায় নিয়ে গেছে। তাই এর সাথে জড়িত কুমোরদের (পাল) জীবন হয়ে উঠেছে আরও অমসৃণ।
তেমনই একজন কুমোর জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের বাড়ইপটল পালপাড়া গ্রামের গৌর চন্দ্র পাল (৬০) । সংসার চালাতে পূর্ব পুরুষের পেশাই বেছে নিয়েছেন তিনি। তবে মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা আগের মতো না থাকায় এসব জিনিস মাথায় গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়ান তিনি।
এলাকাবাসী জানায়, শুধু গৌর চন্দ্র পালই নয়ই, বাড়ইপটল গ্রামে আদিকাল থেকেই কুমার পালদের বসবাস। এ কারণে অনেকেই পালপাড়াকে কুমারপাড়া নামে ডাকে। গৌর চন্দ্রের বাপ-দাদার পেশাও ছিল মাটির দিয়ে হাড়ি-পাতিল তৈরি ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে হাড়ি-পাতিল বিক্রি করা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ডিজিটাল সময়ে এখন মাটির তৈরি বাসন ও তৈজসপত্রের চাহিদা নেই বললেই চলে। তবু পূর্বপুরুষের পেশা আকড়ে ধরে জীবন চালাচ্ছেন গৌর চন্দ্র পাল। বয়সের ভারে ন্যুজ হলে কি হবে গৌর চন্দ্রে পালের? তবুও মাথায় ঝাঁকা (বাঁশের তৈরি মাটির পাত্র নেওয়ার খাঁচা) ভর্তি করে মাটির তৈরি প্রয়োজনীয় ও সৌখিন জিনিসপত্র ফেরি করে চলছেন তিনি। এই তো সেদিন কথা হলো গৌর চন্দ্রের সাথে।
কথা হয় পিংনা রেলস্টেশন এলাকায় গৌর চন্দ্র পালের সাথে। তিনি বলেন ট্রিবিউনকে বলেন, এখন আধুনিকতার যুগে মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন গ্রামের মানুষের কাছে তেমন কোনো চাহিদা নাই। তবুও বাধ্য হয়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করছি। কোনো কোনো দিন একটু ভাল বিক্রি হয় আরার কোনো কোনো দিন তেমন বিক্রি হয় না। বেচা কেনা না থাকায় খেয়ে না খেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে কোনো রকম করে জীবন চলছে। তার সংসারে স্ত্রীসহ তিন মেয়ে এক ছেলে। সংসারে অনেক কষ্টে দিন চলছে আমার। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখন ঘরে রয়েছে বিবাহ যোগ্য আরও ২টি মেয়ে ছোট ছেলে স্কুলে পড়াশুনা করছে। অন্য কোনো পেশায় কাজ করার শক্তি, সামর্থ্য ও জানাশোনা নেই। তাই বাধ্য হয়ে এই বয়সেও মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, সানকি, চালুন, ব্যাংক, ফুলদানি, পশু-পাখি ও খেলনা বিক্রি করছি।
গৌর চন্দ্র কুমার আরও বলেন, প্রতিদিন কম-বেশি বেচাবিক্রি করতে পারি। যা আয় হয় তা দিয়ে কোনো রকমে টানাটানি করে চলে। কয়েকদিন আগে কিছু সাহায্যও পেয়েছি। কিন্তু স্থায়ী কোনো সুবিধা পাইনি। জীবন সংগ্রামে আমি এক পরাজিত সৈনিক।
একই গ্রামের মনিলাল পাল (৭০) বলেন, এক সময় বাপ-দাদার পেশা ছিলো মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল করা। তখনকার দিনে দেশের যোগাযোগ ছিল নৌকাযোগে। সে সময় দেশের বিভিন্নস্থানে নৌকা দিয়ে সরবরাহ করতেন মাটির তৈরি এসব তৈজসপত্র। এক কালে এসব জিনিসপত্রের চাহিদা ছিল অনেক। কালের বিবর্তনে আজ আমাদের এ পেশা শূন্যের কোটায়।
সুনিল চন্দ্র পাল (৬২) নামে আরেক কুমার বলেন, আগের দিনে ট্রেনে তুলে বাঁশের ঝাঁকা ভরে সরিষাবাড়ি হয়ে জামালপুর, শেরপুরসহ অন্যান্য জেলাতে নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে মাটির তৈরি জিনিস বিক্রি করে আবার ট্রেন দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। এখন আর কেউ মাটির তৈরি জিনিস কিনতে চায় না। তাই এখন আমাদের সংসার জীবন খুব কষ্টে চলছে। আবার অনেকে এ পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছে।
এ বিষয়ে পিংনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এ পেশা বাঁচিয়ে হলে রাখতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। দেশে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করে মাটির তৈজসপত্রের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে। পাশাপাশি কুমারদের জন্য প্রয়োজনীয় বিনা সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ ও সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। তা নাহলে এ শিল্প ইতিহাসে পরিণত হবে।”
মতামত দিন