রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে নেমে মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগের জন্য শিক্ষক নীতিমালা পবির্তন, রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্যপ্রদান করে অবসরগ্রহণসহ ২৩ অভিযোগের প্রমাণ পায় ইউজিসি
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনকে পক্ষপাতমূলক দাবি করে অভিযোগের বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান।
ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সম্পর্কে নিজের অবস্থান জানাতে রবিবার (২৫ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি এ দাবি জানান।
উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান বলেন, “যে কোনো আমলযোগ্য অভিযোগের তদন্ত বাঞ্চনীয়। আমি তদন্তের বিপক্ষে নয়। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ ‘যথাযথ’ হলে তদন্তে আমার একশভাগ সম্মতি আছে। তবে সেই তদন্ত হতে হবে যথাযথ প্রক্রিয়ায়, আইনসিদ্ধভাবে গঠিত ‘পক্ষপাতহীন’ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে। এ বিষয়ে আমি স্পষ্টভাবে গত ৯ সেপ্টেম্বর ইউজিসি-এর চেয়ারম্যানকে পত্র দিয়ে জানিয়েছিলাম।”
তিনি আরও বলেন, “আমি আশা করেছিলাম সেই পত্র বিবেচনায় নিয়ে চেয়ারম্যান মহোদয় পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বরং আমি মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি ইতোমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। বলাবাহুল্য প্রতিবেদনটি তাই একপেশে এবং পক্ষপাতমূলক।”
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে উপাচার্য এসব অভিযোগসমূহের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেন।
এছাড়া মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দিতে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, “সাবেক উপাচার্য মিজান উদ্দীনের সময় প্রণীত নীতিমালায় অনুযায়ী আইন বিভাগ ও আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। এতে যথাক্রমে তিন ও দুটি পদের বিপরীতে ৫টি করে আবেদন জমা পড়ে। পরবর্তীতে স্বল্পসংখ্যক আবদেনের কারণে বিভাগদ্বয়ের সভাপতি শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা শিথিলে লিখিত আবেদন জানায়। এছাড়া আরও কয়েকটি বিভাগ যোগ্যতা শিথিল না হলে শিক্ষক নিয়োগ সম্ভব হবে না বলে মৌখিকভাবে জানায়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২০ জুলাই ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় ২০১৫ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করে ২০১২ সালের নীতিমালা পুর্ণবহালের জন্য রাবি কর্তৃপক্ষে নিকট অনুরোধ করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ৪৭২ তম সিন্ডিকেট সভার ৪৩ নং সিদ্ধান্তে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহার নেতৃত্বে সিন্ডিকেট সদস্য, ডীন ও শিক্ষক সমিতির সভাপতিরসহ ৭ জনকে নিয়ে সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক নিয়োগ নীতিমালা পুনঃপ্রণয়নকল্পে একটি কমিটি গঠন করা হয়। চার মাস পর কমিটির সুপারিশে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পুনঃপ্রণয়ন করা হয়।”
উপাচার্য অভিযোগ করেন, “নতুন নীতিমালায় অনেক বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তখন কেউ কিছু বলেনি। তবে মেয়ে ও জামাতা, আত্মীয়কে নিয়োগ পাওয়ার পরই অভিযোগ তোলা হয়েছে। মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দেওয়ার জন্যই নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়।”
উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান বলেন, “অশুভ রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে এমন একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো এনেছে। সংবাদপত্রের প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানতে পেরেছি আমার অর্থের অনুসন্ধান করার সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের যেকোনো সংস্থা আমার অর্থের অনুসন্ধান করুক। সেই সৎসাহস আমার আছে।”
প্রতিবেদনে “নানা অজুহাতে বাড়ি দখলে” রাখার অভিযোগ প্রসঙ্গে উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান বলেন, “দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার পর আমি অধ্যাপক হিসেবে যে বাড়িটি বরাদ্দ পেয়েছিলাম, সেখানেই ছিলাম। উপাচার্যের বাসভবনে উঠি নাই। যখন উপাচার্যের বাসভবনে উঠেছি, তখনই ওই বাড়িটি ছেড়ে দিয়েছি। অথচ ষড়যন্ত্রকারীরা মিথ্য অভিযোগ করেছে-উপাচার্যের বাসভবন এবং অধ্যাপক হিসেবে বরাদ্দ পাওয়া বাড়িটি আমি একই সময়ে দখলে রেখেছি। যেটা পুরোপুরি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত।”
অধ্যাপক আব্দুস সোবহান বলেন, “আমি দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত বড় বড় আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়ম সংঘটিত হয়। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ঢাকাস্থ অতিথি ভবন ক্রয়ে ১৩ কোটি টাকা, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে হেকেপ প্রকল্পের সাড়ে ৩ কোটি টাকা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণে ৮০ লক্ষ টাকা তছরূপের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য সিন্ডিকেট কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠন করি। এসব অপকর্মের সাথে সংশ্লিষ্টরা নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে আমার বিরুদ্ধে অসত্য অভিযোগসমূহ উত্থাপন করেছে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড.এম আব্দুস সোবহান বলেন, “আসলে প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ নামধারী কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষক নিজেদের অপকর্ম আড়াল করার নিমিত্তেই সরকার ও স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের যোগসাজশে অসত্য অভিযোগসমূহ উত্থাপন করে একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়কে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, অন্য দিকে তেমনি সরকারকেও বঞ্চিত করছে।”
এ সময় ইউজিসি দেওয়া প্রতিবেদনে ২৫টি অভিযোগের ব্যাখ্যা দেন তিনি। অভিযোগ সবগুলোই ভিত্তিহীন বলেও দাবি করেন। তিনি বলেন, “ইউজিসি তদন্ত কমিটি আমাকে কিছু জানায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসে তদন্ত করতে পারতো। দু পক্ষের অভিযোগ সামনে আসতো কিন্তু তারা সেটা করেনি।”
উপাচার্যের নিজস্ব সম্পত্তি অনুসন্ধানে বিষয়ে ড.এম আব্দুস সোবহান বলেন, আমার সব সম্পত্তি সততা দিয়েই হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের সম্পদ, আয়ের উৎস, ব্যাংক হিসাব এবং আয়-ব্যয়ের বিবরণী সরকারের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে অনুসন্ধান হোক আমার কোনো আপত্তি নেই।
নীতিমালা শিথিলের ব্যাপারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, যখন নিয়োগ বোর্ড গঠনের মাধ্যমে দক্ষ, মেধাবীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নিয়োগ বোর্ড যদি মনে করে নিয়োগ দেয়ার মত তারা সেটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করে তখন সেটা সিন্ডিকেটে পাশ করা হয়। এখানে পক্ষপাতের কিছু নাই।
নিজের নামে হেফজখানা নামকরণের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, “হেফজখানা নামকরণ আমার নামে করা হয়নি। আর ওটা মাদ্রাসাও নয় হেফজখানা। গোরস্থান মসজিদ সংস্কার হওয়ার পর মসজিদ কমিটি থেকে হেফজ খানা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ‘সোবহানিয়া আল কুরআনুল কারীম হেফজখানা নামকরণ করা হয়েছে।’ আর সোবহানিয়া শব্দের অর্থ সুন্দর। আর আমার নামের অর্থ আল্লাহর দাস।”
প্রসঙ্গত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতীশিল শিক্ষক সমাজের একাংশের দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে নামে ইউজিসি। সম্প্রতি ইউজিসির তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগের জন্য শিক্ষক নীতিমালা পবির্তন, রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্যপ্রদান করে অবসরগ্রহণসহ, ২৩ অভিযোগের প্রমাণ পায় বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
মতামত দিন