‘এবার হামার যে কি হবে? করোনা আইচ্ছে, আবার শীতে হামরা খামো কি, পড়িমো কি হে আল্লাহ হামারতি দেখ’
ভোরে দেখা যায়, হালকা কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে রাস্ত-ঘাট। কচি ধানপাতায় জড়িয়ে রয়েছে মুক্তোর মতো শিশির বিন্দু। ঘাসের ওপরও ভোরের সূর্য কিরণে হালকা লালচে রঙয়ের ঝিলিক দিচ্ছে শিশির। এসব দৃশ্যই শীতের আগমনী বার্তা দিচ্ছে উত্তরের এই জনপদে।
করোনাভাইরাসে বিশ্বের কাঁপন এখনো বন্ধ হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, শীতে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটবে। একই বক্তব্য শোনা গেছে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠেও। এই সতর্কতা শীত আসার আগেই সবার মাঝে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। পঞ্জিকার হিসাবে শীতের আগমন ঘটতে এখনো মাস দেড়েক বাকি। কিন্তু ভাইরাসটির দ্বিতীয় থাবার জন্যই কি এবার অনেক আগেই দরজায় শীত কড়া নাড়তে শুরু করেছে? এ প্রশ্ন উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওবাসীর।
শরৎকাল বিদায় নিয়েছে ১২ দিন আগে। ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে হেমন্ত ঋতুর যাত্রা। পুঁথিগত ধারণায় হেমন্তের শেষে শীত। কিন্তু আবহাওয়ার পরিবর্তন প্রকৃতির রূপ অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। দেড় মাস পর নয়, শরতের বিদায় এবং হেমন্তের শুরুতে শীত তার আগমনের খবর দিতে শুরু করেছে। হেমন্তের সূচনায় শীতের ছবি বলছে, প্রকৃতি এতদিনের নিয়মে নিজ থেকেই নানা পরিবর্তন আনছে।
দেশের উওরের জেলা ঠাকুরগাঁও এক সময় “নিশ্চিন্তপুর” নামে পরিচিত ছিল। এই নামটি মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিশ্চিন্তে বসবাসের উপযোগী কোনো গ্রাম অথবা জনপদের ছবি। কিংবা মনে পড়ে যায় বিভুতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী” উপন্যাসের “নিশ্চিন্দিপুর” গ্রামের কথা। যদিও অনেকদিন আগেই চাপা পড়ে গেছে ঠাকুরগাঁওয়ের এই “নিশ্চিন্তপুর” নামটি। জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট বলছে, কয়েকজন বিত্তশালী মানুষের খোয়ালী ইচ্ছাকে পূরণ করতে সাধারণের প্রিয় জনপদ নিশ্চিন্তপুরকে পাল্টে করা হয় ঠাকুরগাঁও। আর এ ইতিহাস অজানা রয়েছে বলে নিশ্চিন্তপুর শব্দটি উচ্চারিত হলে কখনো ঠাকুরগাঁওয়ের কথা মনে হয় না। তবে ইতিহাস সচেতন মানুষ আজও আবেগ শিহরিত হৃদয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের সঙ্গে নিশ্চিন্তপুরের কথা মনে করেন।
সেই ঠাকুরগাঁও জেলা এখন মধ্যরাতের পর থেকে হালকা শীতে কাঁপতে শুরু করেছে। তবে পূর্বদিকে লাল আভা দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর হালকা কাঁপন থেমে যায়। হালকা ঠাণ্ডার সাথে ভোরবেলা পড়তে শুরু করেছে হালকা কুয়াশা। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহে ঠাকুরগাঁও জেলায় শীতের আগমন ঘটলেও এবার কার্তিকেও আগাম বাজিয়ে দিয়েছে ঘণ্টাধ্বনি।
ভোরে দেখা যায়, হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা রয়েছে রাস্তঘাট। স্থানীয়রা বলছেন, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির কারণে চলতি বছর আগাম শীত অনুভব হচ্ছে। দিনের বেলা কিছুটা গরম থাকলেও সন্ধ্যা নামার পর থেকেই কুয়াশায় আস্তে আস্তে দৃষ্টিসীমা কমে আসতে থাকে। রাতভর হালকা বৃষ্টির মত টুপটাপ করে কুয়াশা ঝরতে থাকে। বিশেষ করে ঘাসের ডগা ও ধানগাছের আগায় জমতে দেখা যাচ্ছে বিন্দু বিন্দু শিশির কণা।
শহর ও শহরতলী ছাড়িয়ে গ্রামগুলোতে দেখা গেছে, পুরনো কাঁথা নতুন করে সেলাই কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারীরা। বাড়ির পাশে গাছের নিচে বসে নানা রঙের সুতো দিয়ে তারা তৈরি করছেন শীতের কাঁথা।
সবজি চাষি কাসেম জানালেন, অসময়ে হালকা শীতের কারণে ফসলে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস আক্রমণ শুরু করেছে। ফসল রক্ষায় এখন কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়া বিকল্প পথ নেই। সাধারণত কার্তিক মাসে এমনটি হয় না। কীটনাশকের জন্য এখন উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে।
ঠাকুরগাঁও পৌর এলাকার শাহাবুদ্দিন বলেন, গত কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টির কারণে এবার অনেক আগেই শীত অনুভব হচ্ছে। দিনে কিছুটা গরম থাকলেও সন্ধ্যা নামার পর থেকেই কুয়াশা পড়তে শুরু করে।
বাসচালক আইনালের সাথে কথা হলে তিনি জানান, গত বছর এমন সময় কোনো কুয়াশা দেখা যায়নি। গত দু’দিন ধরে সকালে বাস নিয়ে বের হবার সময় হেডলাইড জ্বালিয়ে রাস্তায় চলাচল করতে হচ্ছে।
শীত নিয়ে চিন্তিত মোহাম্মদপুর গ্রামের বয়স্ক খলিলুর রহমান ও খয়রুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “এবার হামার যে কি হবে? করোনা আইচ্ছে, আবার শীতে হামরা খামো কি, পড়িমো কি হে আল্লাহ হামারতি দেখ।”
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আফতাব হোসেন বলেন, “কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টিতে উঁচু-নিচু জমিতে পানি জমেছে। সবজি চাষে বৃষ্টির পানি ও শীতের কারণে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস দেখা দিতে পারে। কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ে কর্মীরা কৃষকদের কারিগরি সহায়তাসহ বিভিন্ন রকমের পরামর্শ দিচ্ছেন।”
ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার রকিবুল আলম জানান, স্বাস্থ্য নিয়ে সবাইকে সচেতন করার কাজ চলছে। হাসপাতালে শীতের জন্য আরও ৫০টি বেড বৃদ্ধিসহ স্টাফদের যথাযথ প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ শীতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয় রয়েছে।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ড. এবিএম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, “এ জেলা শীতপ্রধান হওয়ায় গত বছর থেকে আমরা কম্বলের পাশাপাশি বয়ষ্ক ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর মধ্যে লেপ বিতরণ শুরু করে মানুষের কাছ থেকে ইতিবাচক সারা পেয়েছি।”
এ বছর লেপের সংখ্যা বাড়াবার উদ্যোগ নেবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “সাধারণ শীত মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি যথেষ্ট থাকলেও এবার শীতের সাথে আছে করোনা বৃদ্ধির আশংকা আছে, তাই অন্য বছরের চাইতে এ যুদ্ধটা আমাদের জন্য কঠিন হতে পারে। তবে করোনা মোকাবিলার মতোই সফলভাবে সবার সহযোগিতায় এ সম্ভাব্য দূর্যোগকে আমরা পরাজিত করতে সক্ষম হব বলে বিশ্বাস করি।”
মতামত দিন