সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞগন মনে করেন, যেহেতু অপরিণত বয়সীদের উপর টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয় নি তাই শুরুতেই শিশুদের ওপর টিকা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না
দীর্ঘ এক বছর বিরতির পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেয়ার পাশাপাশি সরকার ১৮ বছরের কম বয়সীদের শুরুতেই টিকা প্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বয়স্কদের তুলনায় কম বয়সীদের উপর ভাইরাসের আক্রমণের ব্যাপকতা ততটা ভয়াবহ ছিলো না।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞগণ এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে একমত হয়েছেন এই মর্মে যে, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ওপর যেহেতু টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়নি, তাই শিশুদের টিকাদান এই মূহুর্তে যথাযথ সিদ্ধান্ত হবে না।
সরকারের সংক্রামক রোগতত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা কেন্দ্রের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশফিক হোসেন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, অল্প বয়সীদের উপর টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা হয়নি এবং এই একটি কারণে ১৮ বছরের কম বয়সীদের টিকা প্রদানের অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, "সদ্যপ্রসূতি মা, গর্ভবতী নারী এবং অপরিণত বয়সীদের উপর টিকা প্রয়োগ এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়ে সীমিত পরিসরে কিছু গবেষক কাজ করলেও ব্যপকভাবে বিষয়টি উপেক্ষিত থাকায় টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা বা সেটি কতটা মারাত্মক হতে পারে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হবার কোন উপায় নেই।‘’
তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাসে অতিমাত্রায় আক্রান্ত এবং প্রচণ্ড অসুস্থদের টিকা প্রদান করা উচিত জরুরিভিত্তিতে।
যদিও বাংলাদেশের বয়স্কদের সংখ্যার তুলনামূলক বিচারে তরুণ জনগোষ্ঠী অনেক বেশি তথাপি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী গুরুতর অসুস্থ, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরাসরি জড়িত ব্যাক্তি এবং আক্রান্ত হবার সম্ভবনা অনেক বেশি এমন জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাদানের আওতায় আনা হবে। তবে এমন নয় যে ১৮ বছরে কম বয়সীদের একেবারে টিকা প্রদান করা হবে না, বলেন তিনি।
ফাইজারের টিকা সর্বনিম্ন ১২ বছর বয়সীদের উপর পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। আবার মডার্না বায়োটেক কোম্পানীর টিকা ১৮ বছরের কম বয়সীদের উপর প্রয়োগ করা হয় নি। বিবিসির দেয়া তথ্য অনুসারে, অক্সফোর্ড টিকার সাথে জড়িত গবেষকগণ দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫-১২ বছর বয়সীদের ওপর টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষার পরিকল্পনা করেছেন।
বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পর্যায়ের টিকাদান পরিকল্পনা অনুযায়ী কোভিড ১৯ এর প্রথম সারির মানুষ যেমন ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্য, ৬৪ বছরের অধিক বয়সী নাগরিক এবং জটিল রোগে আক্রান্ত নাগরিক অগ্রাধিকার তালিকার অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য হবেন।
আইইডিসিআর উপদেষ্টা আরও বলেন, এই মূহুর্তে টিকা শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য হলেও ৮০ ভাগ টিকাদান নিশ্চিত করতে হলে ১৮ বছরের কম বয়সীদের অবশ্যই টিকাদানের আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, ’’প্রথম পর্যায়ে অপ্রাপ্তবয়স্কদের টিকা প্রদান করা হবে না, কারণ, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে করোনাভাইরাসে তরুণদের তুলনায় বয়স্কদের আক্রান্ত ও মৃত্যুহার অনেক বেশি।‘’
টিকাদানের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া নীতিমালা অনুসারে, শিশুদের করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া শিশুদের খুব নগন্য সংখ্যায় সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেলেও তাদের খুব দ্রুত সেরে উঠা, অতি সামান্য লক্ষণ প্রকাশ এমনকি কোনো ধরনের লক্ষণ প্রকাশ না করার নজিরও রয়েছে। কিন্ত একই রোগ বয়স্কদের ক্ষেত্রে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে স্বল্প সময়ে। তাই বয়স্কদের অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকে এ পর্যন্ত (২৩ জানুয়ারি) ৮ হাজার ৩ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ৯৭ জন ২০ বছরের কম বয়সী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ মাত্র ১.২১ শতাংশ।
টিকাদানের আওতামুক্ত থাকার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর বিষয়টি অভিভাবক এবং সচেতন নাগরিক মহলে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রমে উপস্থিত হবার উপযোগি পরিবেশ গড়ে তোলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঘোষণা প্রদানের সাথে সাথে যেন স্কুল এবং কলেজের কার্যক্রম শুরু করতে পারে সেজন্য এই নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ফরুহাদ উদ্দিন হাসান চৌধুরী মারুফ ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, শিশুরা করোনাভাইরাসে তুলনামূলক কম আক্রান্ত হলেও সরকারকে সচেতন থাকতে হবে সর্বদা। কারণ, আক্রান্ত না হলেও শিশুরা বাহক হিসেবে রোগ ছড়ানোতে ভূমিকা রাখতে পারে।
তিনি স্কুল এবং শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রম পর্যায়ক্রম অনুসারে চালানোর পরামর্শ প্রদান করেন।
প্রতিবেদকের কাছে তিনি মন্তব্য করেন, ’’অপেক্ষাকৃত কম সংক্রমিত এলাকা যেমন রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবানে স্কুল চালু করে পরীক্ষামূলকভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পর্যায়ক্রমে গোটা দেশে এবং উচ্চ সংক্রমণ ঝুঁকির এলাকা, যেমন-ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে স্কুল কলেজ খুলে দেয়া যেতে পারে। এখনো কেন ওইসব অঞ্চলে স্কুল কলেজ বন্ধ রাখা হচ্ছে তা আমার জানা নেই।‘’
তিনি আরও বলেন, ১৮ বছরের কম বয়সীদের টিকা প্রয়োগ না করলে তাতে ঝুঁকি নেই। কারণ, টিকা গ্রহণকারীরা কোনো বাহকের সংস্পর্শে আসলেও তখন তার আক্রান্ত হবার সম্ভবনা থাকবে না।
‘’টিকাদান কর্মসূচীর মূল উদ্দেশ্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষদের মাঝে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং ছড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা করা। বয়স এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, বয়সের সাথে রোগাক্রান্ত হবার সম্ভবনা বৃদ্ধি পায়’’, তিনি যোগ করেন।
রাজধানীতে ৪০০-৫০০ জনকে পরীক্ষামূলক টিকা প্রদানের মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করা হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী, পুরো দেশজুড়ে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হতে পারে ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ থেকে।
মতামত দিন