গত ২৩ দিনে ৫২ জন সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারি) রোগীর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. তোফায়েল আহমদ সনি। ইন্টারনেটে ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব থেকে নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি শিখেছেন ৩১ বছর বয়সী এই চিকিৎসক। আর দেশের এমন ক্রান্তিলগ্নে সেই স্বীয় অর্জিত বিদ্যাকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে নমুনা সংগ্রহ করতে ভয় পেতেন অনেক স্বাস্থ্যকর্মী। উপরন্তু ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ল্যাব টেকনিশিয়ান বয়স্ক ও ডায়বেটিকস রোগী। তাই কর্মস্থলের এলাকার মানুষকে সেবা দিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সন্দেহভাজনদের নুমনা সংগ্রহ করছেন ডা. তোফায়েল আহমেদ।
মুঠোফোনে তিনি ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করার সময় ইউটিউব থেকে নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা লাভ করি। পরে চীনে কোভিড-১৯ মহামারি দেখা দিলে সেখানকার প্রশিক্ষিত প্যাথলজিস্টরা কীভাবে নমুনা সংগ্রহ করেন ইন্টারনেট ঘেঁটে তা জানার চেষ্টা করি। টানা ১০ দিন চীনের প্যাথলজিস্টদের নমুনা সংগ্রহের ভিডিও দেখে বেশ পরিষ্কার ধারণা পাই। ইন্টার্নিশিপের বিদ্যা ও ইন্টারনেটের ভিডিও দেখে বেশ ভালভাবেই বিষয়টি রপ্ত করি। সেগুলোকে পুঁজি করেই নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করি। শুরুর দিনে ছাতক সদরের বাগবাড়ি আবাসিক এলাকা থেকে এক ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করি।”
এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন স্বাস্থ্যকর্মী স্বপন কুমার রায়।
গত ২৫ তারিখে ডা, তোফায়েল ও তার দল ছাতকের আকিজ প্লাস্টিক কোম্পানির কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন।
প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাতকে আসা ব্যক্তিদের তালিকা থেকে প্রাথমিকভাবে সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে চারটি বিষয় প্রধান্য দেওয়া হয়- প্রথমত: উপসর্গ (সর্দি, কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট) থাকলে, দ্বিতীয়ত: ১৪ দিনের মধ্যে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত হলে, তৃতীয়ত: করোনাভাইরাসের রেডজোন এলাকা থেকে এলে এবং চতুর্থত: হাসপাতালে কাজ অথবা নিয়মিত যাতায়াত আছে এমন কারও সংস্পর্শে এলে।
এছাড়া ঢাকা, নরসিংদী, ময়নসিংহ, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও সাভারফেরৎ সন্দেহভাজনদের শরীর থেকেও নমুনা সংগ্রহ করেন তারা।
এলাকায় ঘুরে ঘুরে এভাবে নমুনা সংগ্রহের কথা শুনে স্বজন, শুভানুধ্যায়ী ও বন্ধুরা সবাই না করেছে।
কিন্তু সাহসী এই চিকিৎসক বলেন, “আমার কাছে বিষয়টি দেশের জন্য যুদ্ধে যাওয়ার মতো।”
গ্রামে গ্রামে ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করছেন তারা। ছবি: ঢাকা ট্রিবিউন
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া চিকিৎসক মঈন উদ্দিনের দাফন কার্যক্রমে সরাসরি অংশ নেওয়া একমাত্র চিকিৎসকও ডা. তোফায়েল।
তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক প্রতিকুলতার মোকাবেলা করতে হয়। নমুনা পরীক্ষার সময় সন্দেহভাজনরা সহযোগিতা না করতে চাইলে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করতে হয়। শুরুতে তাদের বোঝানোর কাজটি করেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। তারপরেও অনেকে নমুনা দিতে চান না। সেক্ষেত্রে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে আস্থা অর্জন করে কাজ করতে হয়।
একজনের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে তিনজন স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজন। একজন সংগ্রহ করেন, একজন তাকে সহায়তা করেন এবং আরেকজন তথ্য লিখেন।
ডা. তোফায়েলের নেতৃত্বে ছাতকে তিনটি টিম নমুনা সংগ্রহের কাজ করছে। প্রতিটি টিমে ৭ থেকে ৮ জন করে লোক থাকেন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে ছাতকের স্বাস্থ্যকর্মীদের এ বিষয়ে তেমন কোনো প্রশিক্ষণ ছিলো না। এই সঙ্কটের মুখে তোফায়েল সরাসরি মাঠে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলে পরিবারের সবাই নিষেধ করেন। তবে মা তাকে অভয় দেন। মায়ের উৎসাহে তিনি দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ডা. তোফায়েল জানান, নিজে আক্রান্ত না হলে ছাতকে কাজ করে যাবেন তিনি।
“একজন চিকিৎসকের কখনোই রোগকে ভয় পাওয়া উচিত নয়। সব কিছু জেনে-বুঝে শুনে চিকিৎসা পেশায় এসেছি।”
ডা. তোফায়েল আহমদ সনি। ছবি: ঢাকা ট্রিবিউন
তার এমন অকুতোভয় উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন স্থানীয়রা।
ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাজীব চক্রবর্তী বলেন, চিকিৎসকরা সাধারণত সরাসরি নমুনা সংগ্রহের কাজটি করেন না। তাদের কাজ বিষয়টির সার্বিক তত্ত্বাবধান করা। কিন্তু ডা. তোফায়েল আহমদ সনি স্বেচ্ছায় কাজটি করছেন। তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক।
তরুণ এই চিকিৎসকের প্রশংসা করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. গোলাম কবির জানান, “সব ভয়ভীতি ও দ্বিধা কাটিয়ে তিনি যেভাবে একাই নমুনা সংগ্রহের কাজ করে যাচ্ছেন, তা প্রশংসনীয়। তিনি ছাড়াও অনেকেই এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাদেরকেও আমরা ধন্যবাদ জানাই। আশা করি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠবো।”
সুনামগঞ্জ ৫ আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, “ডাক্তার তোফায়েল আহমদ সনি একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক। মহামারির সময় তিনি মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যে অন্যন্য ভুমিকা পালন করছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।”
২ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ডা. তোফায়েল সংগ্রহ করেছেন ৫২ জনের নমুনা।