করোনাভাইরাস মহামারিতে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। খেটে খাওয়া মানুষের জন্যই দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে রাস্তার পশুপাখিদের খোঁজ কে নেয়? কিন্তু এই দুর্যোগে দুঃস্থ-অসহায় মানুষকে সহযোগিতার পাশাপাশি বেওয়ারিশ পশুদের প্রতি ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পশুপ্রেমী এক দম্পতি। রাতের রাস্তায় রাস্তায় অলিতে-গলিতে ঘুরে ঘুরে অভুক্ত পশুদের খাবার দেন এই দম্পতি। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে পশুদের প্রতি ভালোবাসার এমন বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন তারা।
আলোচিত এই দম্পতি হচ্ছেন কুষ্টিয়ার পোল্টি ও ফিস ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেএনবি এগ্রো ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান নাসির ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান চামেলি জামান। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ওই ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, নিজে গাড়ি চালিয়ে প্রতিদিন রাতে কুষ্টিয়া শহর এবং শহরতলীর প্রতিটি রাস্তা ও অলি-গলিতে ঘুরে ঘুরে কুকুরের মুখে রান্নাকরা খাবার তুলে দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরছেন কামরুজ্জামান নাসির ও তার স্ত্রী চামেলি জামান।
শহর এবং শহরতলীর এসব কুকুরদের খাবারের বেশিরভাগ সংস্থান হয়ে থাকে হোটেল-রেস্তোরার উচ্ছিষ্ট, ফেলে দেওয়া বাসি-পঁচা খাবার এবং বাসা বাড়ির ফেলে দেওয়া খাবার থেকে। গত ২৪ মার্চ থেকে ঘোষিত লকডাউনের কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকান-পাট, হোটেল-রোস্তোরা সব বন্ধ। এ অবস্থায় মানুষের পাশাপাশি রাস্তার ভাসমান কুকুরগুলোরও চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয়।
তাই সরকারি ছুটির ঘোষণার পর গত মার্চ থেকে প্রতিদিন কুষ্টিয়া শহর, শহরতলীর এনএস রোড, মজমপুর, চৌড়হাস, হাউজিং, নিশান মোড়, বটতৈলসহ মূলসড়ক ও অলি-গলিতে ঘুরে ঘুরে শতাধিক কুকুরের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন পশুপ্রেমী এই দম্পতি।
শুধু পশু নয়; এই দুর্দিনে তারা দুঃস্থ-অসহায় মানুষের পাশেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিজ ইউনিয়ন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার খোর্দ্দ আইলচারা এবং বটতৈল ইউনিয়নের এক হাজার দুঃস্থ মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন ১৫ দিনের খাবার। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলেও অর্থ সহযোগিতা করেছেন। স্থানীয় জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, পৌর মেয়রসহ ত্রাণ নিয়ে যারা কাজ করছেন সেসব প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকেও আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন এই দম্পতি।
সোমবার (১১ মে) রাত ১১টা। চারদিক শুনশান নিরবতা। রাস্তায় কুকুর-শিয়াল ছাড়া কোনো মানুষ নেই। এর মধ্যে কুষ্টিয়া শহরের আমলাপাড়ার রাস্তায় একটি কালো রংয়ের জিপ এসে থামলো। ৪-৫ টা কুকুর রাস্তায় শুয়ে আছে। গাড়ির শব্দ পেয়ে ওরা চারপায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে কুকুরগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন একজন পুরুষ ও একজন নারী। রাস্তায় রেখে দিলেন খাবারের প্যাকেটগুলো। কালবিলম্ব না করেই কুকুরগুলো কে কার আগে খাবার খাবে যেন তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করলো। এ দৃশ্য দেখে এগিয়ে যান এই প্রতিবেদক। এ সময় কথা হয় পশুপ্রেমী স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে।
কামরুজ্জামান নাসির বলেন, “প্রাণী জগতে কুকুর প্রভুভক্ত ও মানুষের উপকারি বন্ধু। মনিবের জন্য জীবন দেওয়ার মত অসংখ্য নজির এদের রয়েছে। এদের একটি অংশ গৃহপালিত। তবে এদের বড় একটি অংশেরই পথেই জন্ম, পথেই বসবাস। তাদের খাবারের জোগান হয় ডাস্টবিন ও নালা-নর্দমায় ফেলে দেওয়া গৃহস্থালি ও হোটেল-রেঁস্তোরার খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশে।
তবে করোনাভাইরাসের কারণে হোটেল-রেঁস্তোরা বন্ধ থাকায় এবং গৃহবন্দী মানুষের জীবনযাপনে সীমিত রান্না-বান্নার কারণে ডাস্টবিন ও নালা-নর্দমায় খাবারের উচ্ছিষ্ট নেই বললেই চলে। এ কারণে পথের এসব কুকুরগুলোকে অভুক্তই থাকতে হচ্ছে। মধ্যরাতে ক্ষুধাকাতর কুকুরের আকুল বিলাপে আমার মন কাঁদে। আমার মত অনেকেরই হয়তো খারাপ লাগে। এই পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য নয়, খোদাসৃষ্ট সকল প্রাণীকূলের জন্যই এই পৃথিবী।”
রোটারিয়ান চামেলি জামান বলেন, “মানুষের একতরফা কর্তৃত্বে মানুষই শ্রেষ্ঠ। তাই অন্য প্রাণীকূল আজ বিপন্ন। অথচ প্রাণীর সম্মিলিত সহযোগে প্রকৃতির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত। তাই শুধু মানুষই নয়, সকল প্রাণীও প্রকৃতির সঙ্গী। করোনা দুর্যোগকালীন দুঃসময়ে আমাদের সবার উচিত এই শিক্ষা গ্রহণ করা । আমরা এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরে রাস্তায় ঘুরে কুকুরদের খাবার দিয়ে যাচ্ছি। এই দুর্দিনে মানুষের পাশাপাশি একটি পশু-পাখিও যেন না খেয়ে থাকে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত সে দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা। আমরা যেন ভুলে না যাই, জীবে দয়া করে যে জন সে জন সেবিছে ঈশ্বর।”