সিলেটে চার হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন এক ব্যবসায়ী।
শুক্রবার (৫ জুন) সকালে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন না পেয়ে চিকিৎসার অভাবেই ওই ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার স্বজনরা।
ইকবাল হোসেন খোকা (৫৫) নামের ওই ব্যবসায়ী নগরীর বন্দরবাজারের আর এল ইলেকট্রনিকের স্বত্বাধিকারী ও সিলেট নগরীর কুমারপাড়ার বাসিন্দা । এর আগে গত ৩১ মে সিলেটের ৬টি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান নগরীর মোগলীটুলার আরেক মহিলা। এ নিয়ে ঢাকা ট্রিবিউনে একটি রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছিল।
ইকবাল হোসেন খোকার ছেলে তিহাম জানান, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তার বাবার বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তখন তিনি প্রথমেই সোবাহানীঘাট এলাকার ওয়েসিস হাসাপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য কল করেন। অ্যাম্বুলেন্স বাসায় আসার পর দেখা যায় এর সঙ্গে যে অক্সিজেন সিস্টেম রয়েছে সেটি ভাঙ্গা। তাই এই অবস্থায়ই রোগীকে সোবাহানীঘাটের ঐ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি বার বার তাদেরকে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করলেও তারা রোগীকে রেখে নিয়মকানুন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। এক পর্যায়ে জানান তারা রোগীকে রাখবেন না, নর্থ ইস্ট হাসপাতালে নিয়ে যেতে। অনেক অনুরোধ করার পরও তারা অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে দেন নি। পরে আমরা রোগীকে নিয়ে দক্ষিণ সুরমার নর্থ ইস্ট হাসপাতালে যাই। সেখানে গেলে কর্তৃপক্ষ জানান, তাদের হাসপাতালে সিট নেই, রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। তখন আমরা পরিচিত এক চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের পরামর্শ দেন শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।
তিহাম অভিযোগ করে বলেন, “শামসুদ্দিন হাসপাতালে গিয়ে তারা সবকিছু বন্ধ পান। ১০-১৫ মিনিট পরে এক নিরাপত্তাকর্মী এসে জানান হাসপাতালের সবাই ঘুমে। অন্য কোথাও রোগীকে নিয়ে যেতে। তখন তারা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে রওনা হন। সেখানে জরুরি বিভাগে যাওয়ার পর তারা সিসিইউতে নিয়ে একটি ইসিজি করেন। এরপরই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার বাবাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।”
দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদেরও চিকিৎসা দেয়ার সরকারি নির্দেশনা থাকার পরও শংকটাপন্ন অবস্থায় সিলেটের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ভর্তি না করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন মারা যাওয়া রোগীর পরিবারের স্বজনরা।
সিলেট মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্যকল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল ইসলাম জানান, কেবল তাদের ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন নয়, সিলেট আরো অনেক রোগী চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য এ ব্যবসায়ী নেতার।
এ বিষয়ে নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. নাজমুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার রাত ৪টা পর্যন্ত তিনি অন ডিউটিতে ছিলেন। এ ধরনের রোগী তাদের হাসপাতালে গেছেন বলে তার জানা নেই। এরপরও তিনি বিষয়টি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আরএমও(আবাসিক মেডিকেল অফিসার) সুশান্ত মহাপাত্র জানান, শুক্রবার ওই রোগীকে ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে নিয়ে আসা হয়। রোগীর দুই জন তখন অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামলেও রোগীকে নামানো হয়নি। অথচ তখন তাদের হাসপাতালের প্রধানফটকসহ সবকিছু খোলা ছিল। সকাল ৫ টা ৪৮ মিনিটের দিকে রোগীকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোগীকে ওসমানী হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি জানান, ঘটনা শোনার পর তিনি ওই রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে সান্ত্বনা দিয়েছেন। তিনি এও বলেন, “শামসুদ্দিন হাসপাতাল একটি সরকারি হাসপাতাল। এ হাসপাতালের বিরুদ্ধে অপপ্রচার দু:খজনক।”
তিনি বলেন, “রোগীর সবকিছু হাসপাতালের সিসিটিভি ক্যামেরাতে সংরক্ষিত আছে। তিনি জানান, শামসুদ্দিন হাসপাতালে এমনিতে রোগীদের চাপ। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে ৫০ জন করোনা পজিটিভ এবং ২৫ জন সন্দেহভাজন রোগী ভর্তি ছিলেন।”
সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান জানান, তিনিও এ ধরনের একটি খবর পেয়েছেন। কিন্তু, এসব ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, কেউই লিখিত অভিযোগ দেন না। লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। এ ধরণের রোগীদের নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে না ঘুরে সরাসরি ওসমানী হাসপাতালে যাবার পরামর্শ দেন এ চিকিৎসা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অনেকক্ষেত্রে সর্বশেষ পর্যায়ে রোগীকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের চিকিৎসকদের ওই সময়ে ঘুমে থাকার কথা নয়।
এ ব্যাপারে ওয়েসিস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, নগরীর কাজিরবাজার মোগলীটুলা এলাকার (বাসা এ/৫) এর লেচু মিয়ার স্ত্রী মনোয়ার বেগম (৬৩) গত ৩১ মে দিবাগত সিলেটের ৬ হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান। একই পরদিন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে স্ট্রোক করে সিলেটে আসা এক রোগী ৭টি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান।এদিকে, এই দুটি ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোকে সতর্ক করে চিঠি দেয়া হলেও আবারো ঘটল প্রায় একই ধরণের ঘটনা।