গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে ধর্ষণের শিকার হন ও-লেভেল পড়ুয়া এক স্কুল শিক্ষার্থী। অতিরিক্ত রক্তপাত শুরু হলে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন মেয়েটিকে।
ঘটনাটি প্রকাশের পর ধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি ফারদিন ইফতেখার দিহান অপরাধী কি না সেটি নির্ধারণের পূর্বেই, কিছু মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দোষী সাব্যস্ত করেন ভুক্তভোগী মেয়েটি ও তার পরিবারকে। একটি অংশ হুমড়ি খেয়ে পড়ে এই ঘটনায় মেয়েটির কী দোষ আছে সেটি প্রমাণের লক্ষ্যে।
“মেয়েটা কেউ নেই বাসায় জানার পরও কেন একা গেলো?”, “মেয়েটার ছেলেদের সাথে বন্ধুত্বের কী দরকার?”, “মেয়েটার মা কোন সামাজিক বা নৈতিক শিক্ষাই দেয়নি মেয়েটাকে!”, “নিশ্চয়ই মেয়ের পরিধেয় কাপড় ইসলামিক বিধান অনুযায়ী ছিলো না” এসবই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরতে থাকা অনেক প্রশ্নের আর মতামতের কিছু অংশ।
দিহানের ফাঁকা বাসায় স্বেচ্ছায় যাওয়া ভুক্তভোগীর অপরাধ এবং সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা না দেওয়া তার মায়ের অপরাধ, এমনটিই বলে চলেছেন তারা।
যদিও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ভুক্তভোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ।
ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশের পর এমন প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। গেল বছর ২০২০ সালে দেশে যখন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রায় ১৬২৭ জনের বেশি নারী, সেসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষণের পেছনে বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করানোর উৎসবে মত্ত একটি পক্ষ।
সমন্বিত ভাবনা
সমাজচিন্তাবিদ এবং সমাজকর্মীদের মতে ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার হাতের নাগালে চলে আসায় বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ নিজের মতামত প্রকাশে সুযোগ পাচ্ছেন কিন্ত এর ব্যবহার বিধি সম্পর্কে অজ্ঞতা রয়ে গেছে অনেক।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যক্তিকেন্দ্রিক মত প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠলেও এটা দুঃখজনক যে জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই ভুক্তভোগীর দিকে আংগুল তুলতে এইসব মাধ্যম ব্যবহার করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, “শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু সমর্থক এবং পৃষ্ঠপোষকতা পাবার আশায় এই ধরণের মতামত মানুষ প্রকাশ করে। কারণ নেতিবাচক চিন্তাধারার মানুষের সংখ্যাই বেশি।”
অধ্যাপক জিয়া ঢাকা ট্রিবিউনকে আরও বলেন, ‘’আনুপাতিকভাবে উন্নত চিন্তার মানুষের তুলনায় সংকীর্ণ ভাবনার মানুষের সংখ্যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি এবং ধর্ষকের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই চারপাশ থেকে তার প্রতিবাদে ধর্ষককে রক্ষা এবং ভুক্তভোগীকে অপরাধীর আসনে বসাতে ছুটে আসে অন্যপক্ষ।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ধর্ষণের খবরের মন্তব্য অংশটুকু পড়লেই ড. জিয়ার দেওয়া চিত্রের সাথে মিল পাওয়া যাবে সহজেই। মন্তব্যকারীদের একটা বড় অংশই ধর্ষকের পরিবর্তে ধর্ষিতার পরিধেয় পোশাক, স্বাধীন চলাফেরা, পুরুষ বন্ধু থাকা, রাতে কর্মক্ষেত্র থেকে ফেরা, পুরুষ সহকর্মী থাকার মতো বিষয়গুলোর দিকে নির্দেশ করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুক্তভোগীকে অপরাধী করা সেই অপরাধকে কিভাবে উস্কে দিচ্ছে এই বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে বলে ড. জিয়া তার মতামত ব্যক্ত করেন।
পরিবার, শিক্ষা এবং ধর্মের ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিড্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে স্কুল পর্যায়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে যৌন শিক্ষা বা সেক্স এডুকেশন চালুর ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে আসছেন কারণ অনলাইনে পর্নোগ্রাফির দৌরাত্মে তরুণ সমাজ যৌন বিষয়ক ভুল ধারণা এবং বিকৃত ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠছে।”
এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাও অসীম। তিনি বলেন, “একজন বালক তার পিতাকে মায়ের সাথে অসদাচরণ করতে দেখলে মেয়েদের সম্পর্কে তার মনে শ্রদ্ধা ভক্তি আসার সম্ভাবনা খুবই কম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের অপমান করাটাও তার জন্যে সাধারণ আচরণের মতোই মনে হবে।”
প্রফেসর তানিয়া হক আরও বলেন, “ধর্মীয় নেতাগণ তাদের বর্ণনায় নারীদের সম্পর্কে নেতিবাচক এবং অবনমনমূলক বক্তব্য প্রদানের ফলে তাদের অনুসারীগণও একই পথ অনুসরণ করেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দাবানলের মতো এসব মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে। যা সামগ্রিক অবস্থার জন্য ভয়াবহ ফলাফল বয়ে আনছে।”
“অনলাইনে প্রচলিত বহুল প্রচারিত মন্তব্য হলো যদি নারী ইসলামিক অনুশাসন অনুযায়ী পোশাক পরিধান করতেন তাহলে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটতো না। ”
আরেকটি জনপ্রিয় উপমা নারীদের হিজাব পরিধান করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় সেটি হলো নারীরা হচ্ছে ক্যান্ডি মতো আর ধর্ষক হচ্ছে মাছির মতো। কভারে মোড়ানো ক্যান্ডিতে মাছি বসতে না পারার সাথে হিজাব ধর্ষককে দূরে রাখবে এমন তুলনা দিতেই এটি বুঝিয়ে থাকেন একটা পক্ষ। অর্থাৎ শরীর ঢেকে না রাখলে ধর্ষণ হবেই এটি বুঝিয়ে থাকেন এই উদাহরণের মাধ্যমে।
ধর্ষণের পক্ষপাতিত্ব করা অনেকসময় সেলিব্রেটি ও অনলাইনে জনপ্রিয় মুখ এমন অনেকের মাঝেও লক্ষ্য করা যায়।
অভিনেতা অন্তত জলিল তার নিবন্ধিত ফেসবুক পেইজ থেকে গত বছর একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে তিনি নারীদের ধর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে শরীর দেখা যায় এমন কাপড় না পরার আহবান জানান।
পরবর্তীতে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ফলে তিনি ভিডিওটি মুছে ফেলেন কিন্ত ক্ষতি যা হবার তা হয়েছে। প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ ভিডিওটি দেখেছেন এবং এর একটি বড় অংশই তাকে এই ভিডিওর মাধ্যমে “সঠিক কথাটি” বলার জন্য বাহবা দিয়েছেন।
কঠোর শাস্তি
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংস্থার কার্যনির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বলেন, “আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের উচিত ধর্ষণের পক্ষে বলা মানুষদের উপর নজর রাখা কারণ এদের মাধ্যমেও ঘটতে পারে ধর্ষণের মতো ঘটনা।”
তিনি ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “যারা অনলাইনে ধর্ষণের পক্ষে লিখছেন এবং ধর্ষকের কাজকে যৌক্তিক হিসেবে উপস্থাপন করছেন তার ভিনগ্রহের কেউ নয়। তারা এই সমাজেরই মানুষ আর এর মাধ্যমেই আমাদের সমাজের মূল্যবোধ এবং সংকীর্ণ চিন্তাচেতনার চিত্র আমাদের সামনে উঠে আসে। ”
রোকেয়া কবির মনে করেন এখনই সময় উন্নত ও উদার চিন্তা চেতনার মানুষদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের মতামতকে তুলে ধরে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে কাজ করার।
তিনি আরও বলেন- “আমাদের উচিত ধর্ষণের পক্ষে কথা বলা মানুষদের পরিচয় প্রকাশ করা এবং সম্ভব হলে তার কর্মস্থলে সেটি জানিয়ে দেওয়া।” পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উচিত এসব ক্ষেত্রে নজরদারী বৃদ্ধি করা এবং এ বিষয়ক কোন অভিযোগের প্রেক্ষিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, একদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুক্তভোগীর নৈতিক চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ চলছে আর অন্যদিকে বিগত এক বছরে ১৬২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এর মধ্যে ৫৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে আরও ১৫ জন পরবর্তীতে সামাজিক, পারিপার্শ্বিক চাপ সহ্য করতে না পেরে মানসিক যন্ত্রণায় বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ।