জল ও ডাঙায় বিচরণ করা কালিম পাখি কালেভাদ্রে দেখা মেলে পাহাড় আর বনাঞ্চলে। তবে, বনের এই পাখিকে হাঁস-মুরগির মতো পোষ মানিয়ে লালন পালন করছেন ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার বেশ কিছু পরিবার। শত বছর ধরে শখের বশে বংশ পরম্পরায় এই পাখি পুষছেন তারা। পাখি বিক্রি করে আয়ও করছেন অনেকে।
অঞ্চলভেদে এটিকে কালেম, কায়ুম, কালাম, কামিয়া, সুন্দরী নামেও ডাকা হয়। কালিম পাখি খুবই দুঃসাহসী, লড়াকু ও মারকুটে স্বভাবের। দেখতে চকচকে নীলচে বেগুনি। আলতা রঙের কপাল-মাথা ও পা। আর পায়ের আঙ্গুল বেশ লম্বাটে। এদের মূল খাদ্য উদ্ভিদ-গুল্মের কচি পাতা, ব্যাঙাচি বা ছোট মাছ।
তারাকান্দায় যারা এই পাখি লালনপালন করছেন তাদেরই একজন মনসুর আলী (৭২)। তিনি জানালেন, তার দাদা, বাবা এই কালিম পাখি পুষতেন। তাদের পথ ধরেই শখের বসে নিজেও পুষছেন পাখিটি।
তিনি আরও জানান, বাড়ির পাশের চারিয়া বিলে বহুকাল আগে থেকেই কালিম পাখির আগমন ঘটত। সেখান থেকেই তার পূর্বপুরুষেরা পাখি ধরে এনে পোষ মানাতেন। পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকেই মূলত ছোটবেলায় শিখেছেন কিভাবে পোষ মানাতে হয় বদমেজাজি বলে পরিচিত এই পাখিকে।
মনসুর বলেন, পোষ মানার পর এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় পাখিদের সাথে। যেখানেই থাকুক না কেন ডাক দিলেই উড়ে আসে। আর তাদের ডাকে মন তৃপ্ত হয়।
আরও পড়ুন - ডিম পেড়েছে কালিম পাখি
মনসুরের পাশাপাশি গ্রামে পাখি পোষেন এমন আরও বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হয়। তারা জানান, পাখিটি মূলত গৃহিনীরাই লালন-পালন ও দেখভাল করেন।
স্থানীয় জুবেদা নামে এক গৃহিনী বলেন, হাঁস-মুরগীকে যে খাবার দেয়া হয়, সেই একই খাবার এসব পাখিকে দেয়া হয়। সকালে বের হয়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আবার সন্ধ্যায় বাড়িতে চলে আসে কালিম।
আল আমিন নামের একজন বলেন, কালিম পাখি যখন ডিম দেয়া শুরু করে, তখন একমাসে ১০ থেকে ১৫টি ডিম পাড়ে। সেখান থেকে বাচ্চা ফোটে প্রাকৃতিক নিয়মে। এই পাখি আমরা যারা পালন করি তারা ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রিও করি। নিয়মিত পাখিটিকে যত্ন করা আর তার খাবার সরবরাহ করা এখন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
পাশ্ববর্তী বাড়ির দুলাল মিয়ার কালিম পাখি রয়েছে ৬টি। এর মধ্যে ডিম দিচ্ছে দুটি পাখি। তিনি বলেন, ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ শহরসহ দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে পাখি কিনে নিয়ে যায়। তারা বাসা-বাড়িতে এগুলো শখ করে পালে। বয়স অনুযায়ী একেকটা পাখি দুই থেকে সাত হাজার টাকা বিক্রি করা যায়।
আরও পড়ুন - মৌলভীবাজারে বিরল প্রজাতির লজ্জাবতী বানর উদ্ধার
তবে, বন্যপ্রাণী লালন পালনে রয়েছে কিছু আইনের বিধি-নিষেধ। যদিও এ ব্যাপারে গ্রামের মানুষজন খুব একটা সচেতন নয়।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা ইয়াছমিন বলেন, আইনে বলাই আছে বন্যপ্রাণী শিকার বা লালন পালন নিষিদ্ধ। শুধু নিষিদ্ধই না, দণ্ডনীয় অপরাধ। সেক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে লালন-পালন করলে সেটা বৈধ হবে।
ফাহমিদা ইয়াছমিন বলেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে পোষ মানিয়ে যাচ্ছেন তাদের সাথে পাখির সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রার। বন পাহাড়ে পাখির সংখ্যা কমে গেলেও, পোষ মানিয়ে লালন পালনে কিন্তু এর সংখ্যা বাড়ছে। সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে যদি উদ্যোগ নেয়া যেত কিছু পাখি ছেড়ে দেয়ার, তাহলে পাখিটা বনেও বাঁচবে এবং পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হবে। একইসাথে পরিবারগুলো যে উদ্দেশ্যে পাখি পালন করছে সেটিও সফল হবে।
মাথায় আলতা রঙের রক্ষা কবচের জন্য অনেকেই এই পাখিকে তুলনা করেন রোমান যোদ্ধাদের সাথে। প্রচলিত আছে, এরা এতটাই দুঃসাহসী ও লড়াকু যে শিকারিদের ছোঁড়া গুলি এক পায়ে লাগলেও, মুখে সেই পা কামড়ে ধরে উড়ে পালাতে পারে। এক সময় ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেঁষা শেরপুরের নালিতাবাড়ী পাহাড়ি এলাকায় কালিমের অবাধ বিচরণ থাকলেও এখন আর তেমন দেখা মেলে না।
আরও পড়ুন - পদ্মা সেতুর চীনা শ্রমিকদের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো সজারু
বাংলাদেশ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা জোহরা মিলা ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “পাখিটির পুরো নাম বেগুনী কালিম (Purple Swamphen)। তবে এটি কালেম, কায়িম বা কাম পাখি নামেও পরিচিত। পাখিটি হাওর, বিল বা জলাশয়ের পাখি। পদ্ম, শাপলা বা বড় খাসপূর্ণ জলাভূমিতে এরা বেশি থাকে। এরা খুবই সামাজিক পাখি, দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। পাখিটি খাবার হিসেবে ধান, গম, চাল, ঘাস, মাছ, শামুক ইত্যাদি খেলেও কচুরিপানা এদের প্রিয় খাদ্য। বছরে ৭ থেকে ১০টি ডিম দেয় এবং প্রাকৃতিকভাবেই বাচ্চা উৎপাদন করে পাখিটি।”
তিনি জানান, আইনগতভাবে কালিম পাখি খাঁচায় বা অন্য কোনোভাবে লালন-পালন দণ্ডনীয় অপরাধ। এ বিষয়ে পোষাপাখি বিধিমালা নামে নতুন আইন হচ্ছে।
জোহরা মিলা বলেন, “পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই কালিমের দেখা পাওয়া যায়। বিগত কয়েকদশক ধরে সারা পৃথিবীতে কালিমের সংখ্যা কমে না গেলেও বাংলাদেশে জলাভূমি কমে যাওয়া এবং যত্রতত্র ফাঁদ পেতে শিকার করার ফলে পাখিটির হুমকির মুখে রয়েছে। যদিও আইইউসিএন এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইন-২০১২ অনুযায়ী পাখিটি সংরক্ষিত। তাই এটি শিকার বা এর কোনো ক্ষতি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।”
আরও পড়ুন - মৌলভীবাজারে ‘আদালত’ বসিয়ে বানর হত্যা!
আরও পড়ুন - সেই বন বিড়ালটি ফিরে গেলো বনে
আরও পড়ুন - ভাইরাল হওয়া প্রাণীটি চিতাবাঘ নয়, চিতা বিড়ালের বাচ্চা
আরও পড়ুন - খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে ১৫টি বানর হত্যা!