করোনাভাইরাসের লক্ষণ এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে ৬৫ বছর বয়সী রঞ্জু শেখ মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসার পর বিকেল পর্যন্ত করোনভাইরাস ইউনিটের সামনে বসেছিলেন। ভর্তি ও চিকিত্সা পাওয়ার আশায় তিনি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে এসেছিলেন।
তার ছেলে হীরা শেখ একটি ভর্তির টিকিট কিনেছিলেন তবে এক ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালের কোনো কর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হননি তিনি। হতাশ ও বাধ্য হয়ে হীরা অন ডিউটি ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সেখানে থাকা প্রহরীরা হীরাকে ঢুকতে দেয়নি। তারপরও তিনি ভর্তির টিকিটটি হাতে নিয়ে এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছিলেন।
কয়েকশ টাকা খরচ করে হাসপাতালের কর্মীদের সাহায্য পেতে আরও দুই ঘণ্টা সময় চলে যায় তার। অবশেষে বিকেল তিনটার দিকে তার বাবাকে ভর্তির পর একটি বেড দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ততক্ষণে তার অবস্থার আরও অবনতি হয়।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে হীরা ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “এখন সে খেতে পারে না এবং তাকে উচ্চ চাপের অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে।
রঞ্জুর গল্প কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং করোনাভাইরাস সংক্রমণের আকস্মিক ঊর্ধ্বগতির পর এ ধরনের ঘটনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য হাসাপাতালের জন্য নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাসপাতালে ভর্তি
সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ডিএমসিএইচ-এর কোভিড -১৯ ইউনিটে ঢাকা ট্রিবিউনের দুই সংবাদদাতা দেখতে পেয়েছেন, রোগী দুইভাবে হাসপাতালের বেড পেতে পারেন- লবিং অথবা ঘুষ। তাই ক্ষমতাবান লোকেরা সাধারণ মানুষের থেকে বেশি সুবিধা ভোগ করছেন। এছাড়া সাধারণ মানুষের বেশিরভাগেরই ঘুষ দেবার সামর্থ্য নেই।
রোগীদের প্রচুর ভিড়, বেড/ আইসিইউ শূন্য থাকা না থাকা বিষয় নয়, বরং এটিই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি কর্তব্যরত ডাক্তারদের সাথে দেখা করার জন্যও হাসপাতালের কর্মীদের কিছু ঘুষ প্রদান করতে হচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন প্রবাসী রিপন। গত ১২ এপ্রিল তিনি মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। মেহেদী হাসান/ঢাকা ট্রিবিউন
সোমবার সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেলে মহিউদ্দিন তালুকদার নামে এক রোগী। কারণ তার পরিবার বেসরকারি হাসপাতালে চিকিত্সা ব্যয় চালিয়ে নিতে পারছিলেন না।
তিনি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের বাসিন্দা। তার ছেলে মেহেদী তালুকদার ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, তার বাবা ১১ দিন ধরে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
“আমরা এর আগে হাসপাতালের কিছু কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেছি। তারা আমাদের আজ (সোমবার রাতে) আসতে বলেছে। আমাদের শুধু কিছু টাকা (ঘুষ) দেওয়ার দরকার ছিল,” কিন্তু তিনি আফসোস করেছেন যে, কোভিড-১৯ ইউনিটে আসার পর এখন পর্যন্ত তাদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেনি।
মেহেদী বলেন, “হাসপাতালের কর্মীদের মধ্যে একজন ৪৫ মিনিট আমাদেরকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার পর যখন আমি তাকে ৫০০ টাকা দিয়েছিলাম তখন সে আমার বাবার জন্য একটি স্ট্রেচার দিয়েছিল,” মেহেদী বলেন।
ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, অবৈধ অর্থ দাবি করার কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্মীদের অনেককে বরখাস্ত করেছে।
গত ২ এপ্রিল রাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ হাসপাতালের প্রবেশপথে অপেক্ষারত রোগীর স্বজনেরা। মাহমুদ হোসেন অপু/ঢাকা ট্রিবিউন
“যদি কেউ ঘুষ দাবি করে, তবে আমরা ব্যবস্থা নেব,” দাবি করে তিনি বলেন, “চিকিৎসকরা কোভিড -১৯ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বাড়ি পাঠাচ্ছেন, যদি তাদের অবস্থা গুরুতর না দেখা যায়। তবে কোভিড -১৯ পজিটিভ রোগী এবং যাদের অক্সিজেনের দেওয়া প্রয়োজন তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে।”
ঢামেকের দুটি কোভিড -১৯ ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে একটি ৬০১, ৬০২, ৭০১, ৭০২, ৮০১, ৮০২, ৯০১, এবং ৯০২ ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ইউনিট এবং শিশু ইউনিট।
রাতের চিত্র
সোমবার রাত ৯টায় অ্যাম্বুলেন্সে ৬৭ বছর বয়সী এক নারী এসেছিলেন। আসার পথেই তাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ভর্তি করানোর জন্য তার ছেলে ও মেয়ে এদিক ওদিক ছুটছিলেন।
“জ্বরের কারণে আমরা তিনদিন বাড়িতে তার যত্ন নিচ্ছিলাম। আমি বেশ কয়েকদিন কয়েকটি হাসপাতালে একটি বেড ম্যানেজ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। এখন আমি ভাগ্যবান বোধ করছি কারণ অবশেষে আমি এখানে একটি বেড পেয়েছি,” বলছিলেন ওই বৃদ্ধার মেয়ে আজমেরি সুলতানা।
“আমরা শমরিতা হাসপাতালে কেবল তিন ঘণ্টা ছিলামএবং পরে আমি সেখান থেকে বেডের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি। এটি আমার জরুরি ছিল কারণ আমার মায়ের অক্সিজেনের মাত্রা খুব নিচে নেমে গিয়েছিল। আমরা সহজেই বেড পেয়েছি এবং পদ্ধতিগুলো সম্পন্ন করতে কাউকে কোনও অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়নি”, বলেন তিনি।
গত ১২ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বজনের সঙ্গে একজন রোগী। মেহেদী হাসান/ঢাকা ট্রিবিউন
রাত সাড়ে ৯টা থেকে রাত ৯.৪৫ এর মধ্যে আসা কোভিড -১৯ সন্দেহভাজন নারী একটি চেয়ারে বসে অবাক তাকিয়ে ছিলেন। তার ফুসফুসের ৯০% সংক্রমিত হয়েছে এবং তিনি ব্ল্যাড ক্যান্সারেও ভুগছেন।
তার এক নাতি বলেছিলেন, “আমরা এখানে আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির জন্য অপেক্ষা করছি। এখানকার লোকেরা আমাদের চেনে। আশা করছি যে আমরা এখানে একটি বেড পেয়ে যাব।”
রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে নওগাঁ থেকে স্বজনদের সঙ্গে এসেছিলেন ৩০ বছর বয়সী এক নারী। তবে একটি বেড পাওয়ার জন্য তাকে ৪৫ মিনিটও অপেক্ষা করতে হয়নি। যদিও তিনি হাসপাতালের কাউকে চেনেন না। এই বেডটি পেতে তাদেরকে বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘুষ দিতে হয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ওয়ার্ডের দু'জন কর্মী ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “আপনার যদি টাকা এবং ক্ষমতা থাকে তবে এখানে সবকিছু সম্ভব।”
মুগদা হাসপাতালে
কোভিড -১৯ চিকিত্সার জন্য ডেডিকেটেড অন্যান্য হাসপাতালের মতো এই হাসপাতালের অবস্থাও একই রকম ছিল।
গুরুতর শ্বাসকষ্টে মোহাম্মদ রিপন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে সোমবার রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন। এক ঘণ্টা দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষার পরে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন, তবে মাস্ক ঘাটতির কারণে অক্সিজেন দিতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
পরে তার সঙ্গে আসা আত্মীয়রা ফার্মেসি থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাস্ক কিনে দেন। পরে রাত ১০টার দিকে সৌদি আরব প্রবাসী ৩৮ বছর বয়সী রিপনকে অক্সিজেন দেওয়া হয়।
রিপন দু'মাস আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং রবিবার সৌদি ফিরে যাবার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন।
রিপনের আত্মীয় শিল্পী ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমি এখানে আসার আগেই আসনটি ম্যানেজ করেছিলাম।”
গত ১২ এপ্রিল মুগদা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান চিকিৎসাধীন আলী আকবর (৬৫) তাকে সরিয়ে নিচ্ছে হাসপাতালের কর্মীরা। মেহেদী হাসান/ঢাকা ট্রিবিউন
সোমবার রাত সাড়ে ৯টা থেকে রাত সোয়া ১১টা পর্যন্ত হাসপাতালটিতে অবস্থান করা ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদক হাসপাতালের আইসিইউ বেড সম্পর্কে খোঁজ নিতে সমর্থ হন এবং তাতে দেখা যায়- হাসপাতালের সব আইসিইউ বেডেই রোগী ভর্তি রয়েছে। এছাড়া ২২ জন রোগী আইসিইউ বেডের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মী বলেন ৪৮টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ৪০টি "অনানুষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষিত"। মূলত উচ্চতর লবিংয়ের মাধ্যমে যারা হাসপাতালে যাবেন, সেগুলো তাদের জন্য বরাদ্দ হবে।
হাসপাতালের পাসের জন্য অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া দুর্নীতির আরেকটি উপায়।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ভিন্ন চিত্র
আনুমানিক ৬০ বছর বয়সী কুলসুম বেগম রাত সোয়া ৯টায় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হন। একজন অন-ডিউটি নার্স তার অক্সিজেনের মাত্রা ৮১ পান। তারপর আত্মীয়রা তাকে একটি স্ট্রেচারে তুলে নিচতলায় অবস্থিত কোভিড-১৯ আইসোলেশনে নিয়ে যায়।
তিনি একটি বেড পাওয়া ভাগ্যবান। তার আসার আধঘণ্টা আগে একজন রোগী ছাড়পত্র নিয়েছিল। কুলসুম বেগমের ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে আইসোলেশন ওয়ার্ডের ২৩টি বেডই পূর্ণ হয়ে যায়।
কুলসুমের কোভিড -১৯ টেস্টের কোনও রিপোর্ট ছিল না, তবুও অক্সিজেন-স্তর কমে যাওয়াসহ বেশ কয়েকটি লক্ষণ তারমধ্যে ছিল। চার দিন আগে প্রথমে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ফরিদপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে গিয়ে কোনো সিট পাননি তিনি। পরে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসেন তার স্বজনেরা।