জাতিসংঘের মহীসোপান নির্ধারণসংক্রান্ত কমিশনে (সিএলসিএস) বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানের মালিকানা নিয়ে বাংলাদেশের করা দাবিতে আপত্তি জানিয়েছে ভারত।
এর আগে এ বছরের জানুয়ারিতে মহীসোপানের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করলেও ভারতের মতো আপত্তি জানায়নি আরেক প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার।
মূলত সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর সমুদ্রের দিকে পানির নীচে যে ভূখণ্ড ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে যে নেমে যায়, সেই অঞ্চলটিকে "কন্টিনেন্টাল শেলফ" বা মহীসোপান বলা হয়। এই অঞ্চলটিকে সমুদ্র তীরবর্তী ওই দেশেরই অংশ হিসেবে মনে করা হয়।
জাতিসংঘের সিএলসিএস ওয়েবসাইটে শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) প্রকাশিত ভারতের আপত্তিপত্রে বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের যে বেসলাইনের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ মহীসোপান দাবি করছে তা ভারতের মহীসোপানের অংশ।
তবে ভারতের এই বক্তব্যের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব) মো. খুরশেদ আলম বলেন, ''ভারতের আপত্তির প্রেক্ষিতে আইনগত জোরালো কোনো ভিত্তি নেই।''
তিনি আরও বলেন, "আমাদের সীমানা নির্ধারণ করাই আছে। কোনো দেশ তা মানতে না চাইলে আবেদন করতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সিএলসিএসের। যা প্রতিটি দেশকেই মানতে হবে।"
মহীসোপান কীভাবে নির্ধারণ করা হয়?
১৯৫৮ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, সমুদ্র তীরবর্তী যে কোনো দেশের বেসলাইন বা স্থলভাগ থেকে লম্বাভাবে সমুদ্রের দিকে ২০০ মাইল এলাকার মালিক তীরবর্তী দেশটি। এই অঞ্চলটিকে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক অঞ্চল (ইইজেড) বা একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল বলা হয়। ইইজেড অঞ্চলের পানি ও সমুদ্রের তলদেশের ওপর একমাত্র ওই দেশেরই মালিকানা থাকবে। ইইজেড অঞ্চলের সমুদ্রে মালিকানাধীন দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশ মাছ ধরা বা অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে পারবে না। তাই মহীসোপানকে কোনো দেশের বর্ধিত একটি অংশ বলা হয়।
ইইজেড ইঞ্চলের পরের ১৫০ মাইল পর্যন্ত সীমানার পানিতে অন্য যে কোনো দেশ মাছ ধরতে পারলেও এই অঞ্চলের সমুদ্র তলদেশের খনিজ সম্পদের মালিক হবে একমাত্র মালিকানাধীন দেশ। এই ৩৫০ মাইল অঞ্চল ওই দেশের মহীসোপান। এই নিয়ম অনুযায়ীই বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছে ৩৫০ মাইল মহীসোপানের দাবি করেছে।
তবে দেশের আয়তন ও আকারের উপর ভিত্তি করে মহীসোপানের অনুপাত একেক রকম হতে পারে।
মহীসোপান নিয়ে এত আগ্রহ কেন?
সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর অন্যতম প্রধান শক্তি আর জলসীমানা। আর মহীসোপান স্থলসীমার মতো কোনো দেশের জলসীমানার প্রতীক। মহীসোপান এলাকায় মালিকানাধীন দেশটির এক চেটিয়া অধিকার থাকে। পরের ১৫০ মাইল এলাকায় মালিক দেশ ছাড়াও অন্য দেশ মাছ ধরতে পারবে। একে "গ্রে এরিয়া" বলা হয়। কিন্তু গ্রে এরিয়াতে ভূপৃষ্ঠ ও ভূপৃষ্ঠে থাকা সালফার, মেটালিক মডিউল, তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের খনিজের সম্পদের মালিক একমাত্র মালিকানাধীন দেশই হবে।
খনিজ সম্পদ থাকার কারণেই মহীসোপান এলাকা নিয়ে প্রতিবেশী দেশেগুলোর মধ্যে বিরোধ চলতে থাকে। বাংলাদেশের মহীসোপান অঞ্চলেও কয়েকটি গ্যাস ব্লক রয়েছে।
উল্লেখ্য, সমুদ্র সীমানা নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বিরোধ এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা নিয়ে এক বিরোধে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায়ে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার নতুন সমুদ্র এলাকা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্রসীমানাসহ প্রায় ২০০ নটিক্যাল মাইল অঞ্চলের একমাত্র মালিক হয় বাংলাদেশ। এছাড়া ২০১২ সালেও মিয়ানমারের সাথে সীমানা নির্ধারক রায়ে জয়লাভ করেছিল।
ভারতের মহীসোপান আপত্তি
বাংলাদেশ ২০১১ সালে জাতিসংঘের সিএলসিএস বরাবর মহীসোপান দাবি করে আবেদন করলেও ২০২০ সালের অক্টোবরে দাবি সংক্রান্ত সংশোধনী দেয়া হয়।
নতুন প্রাপ্ত এই সীমানার উপর ভিত্তি করেই মহীসোপান দাবি করেছে বাংলাদেশ।