গত বছরের মার্চ মাসে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ মরামারির প্রভাবে বিশ্বের অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও বেড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮%। যা গত তিন বছরে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালে এই বৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৬.৫০% ও ৬.০৮% এবং ২০১৮ সালে ছিল ৬% ও ৫.১৯%।
বুধবার (১৬ জুন) এক প্রেস ব্রিফিংয়ের বরাত দিয়ে "কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ" (ক্যাব) এ তথ্য জানিয়েছে।
তারা আরও জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতি ৬.৩১% বেড়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং ভ্রমণ ব্যয় ব্যতীত গ্রাহকের অধীনে থাকে এমন কোনো পণ্য বা পরিসেবার মূল্য এবং পণ্য বা পরিসেবার মোট ব্যয়কেই জীবনযাত্রার ব্যয় হিসেবে গণনা করা হয়েছে।
ক্যাবের দেওয়া তথ্যানুযায়ী
২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে চালের গড় ব্যয় প্রায় ২০% বেড়েছে।
দেশি ও আমদানি করা ডালের দাম বেড়েছে গড়ে ১৪.১৮% ।এরমধ্যে দেশি ডালের দাম ২৮.৮৯% এবং আমদানিকৃত ডালের দাম ৪৮.৪৫% বেড়েছে।
ভোজ্যতেলের দামও গড়ে ৮.৯৭% বেড়েছে। এর মধ্যে খোলা পাম অয়েল ১৭.১৭% এবং খোলা সয়াবিন ১৪.২৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
চিনি এবং গুড়ের দাম কেজি প্রতি ২৫% এবং বিভিন্ন মশলার দাম গড়ে ২৪.৬৬% বেড়েছে। এর মধ্যে এলাচ বেড়েছে ১০৪.১৮%, দেশি শুকনা মরিচ ৪০.৬৬%, সবুজ মরিচ ৩১.৯৬%, আমদানিকৃত আদা ৩১.০৪%, দেশি পেঁয়াজ ১৮.২৭%, আমদানিকৃত পেঁয়াজ ১৬.৮৩%, এবং আমদানিকৃত শুকনা মরিচ ৩০.৪৯% বৃদ্ধি পেয়েছে।
সবজির দাম গড়ে বেড়েছে ৯.৮৮% । এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে করলার দাম, ৩৪.৩০%। এছাড়া কাঁচা পেঁপে ৩১.১৬%, দেশি আলু ২৫.৫৫% এবং বিদেশি আলু ২৪.৮৬% বেড়েছে।
২০১৯ সালের তুলনায় গরু ও খাসীর মাংসের দাম ১০.৪৯%, মুরগির দাম ১০.৮৩% এবং ডিমের দাম ৫.৩২% বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া মাছের দাম গড়ে ৭.১৩% এবং গুঁড়ো দুধের দাম ৭.৬৪% বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে পানির দাম এক হাজার লিটারে ২৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, আবাসিক বিদ্যুতের গড় ব্যয় ৬.০৫% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাণিজ্যিক বিদ্যুতের গড় মূল্য ৪.৮১% বৃদ্ধি পেয়েছে।
মধ্যবিত্তদের বাড়ি ভাড়া ৫.৩৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক বৃদ্ধি ফ্ল্যাট বাসা-বাড়িগুলোতে ৭.৮৫%, বস্তিতে ৩.৪৫% এবং মেসে বা সিটের ঘরগুলোতে ৩.৪৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, “দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। তবে মূল্যস্ফীতীর ক্ষেত্রে সরবরাহের `চেইন ফ্যাক্টর' দামের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। তবে মহামারিতেও সীমাবদ্ধ নয় এমন নানা দ্রব্যের চাহিদা ক্রয় শক্তি হ্রাসের সাথে সাথে বাড়েনি।"
তিনি আরও বলেন, দেশের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমুল্যের ওঠানামাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবি্ত করে, বিশেষ করে যে কোনো সংকটের সময়েই তারা বিষয়টিকে লাভজনক করে তুলবেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মহামারিতে পরিবারভিত্তিক মাসিক আয় প্রায় ৪ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কমে গেছে।
ইতোমধ্যে, ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসার সাথে জড়িত ৩৭% বা ৭০ লাখ মানুষ ২০২০ সালে চাকরি হারিয়েছেন।
ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) এক জরিপে দেখা গেছে, ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোতে কর্মী ছাঁটাই ও বেতন হ্রাসের ফলে অন্যান্য খাতেও কর্মসংস্থানও হ্রাস পেয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের মতে, জনসংখ্যার ২৯% এখন দরিদ্র
তবে, উত্তরার বাসিন্দা এবং বাড়িওয়ালা শাকিলা ইয়াসমিন আরও কয়েকজনের সাথে মহানগরীতে বাড়ি ভাড়া দাম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “মহামারি আসার সাথে সাথেই ভাড়া কমিয়েছি প্রায় হাজার টাকা। অথচ বিদ্যুৎ ব্যতীত অন্যান্য ইউটিলিটির বাড়ে বা কমেনি।"কমেনি।”
ক্যাবের ভাইস প্রেসিদেন্ট এস এম নাজির হোসেন বলেন, “২০২০ সালে জানুয়ারির শুরুতে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু মার্চ মাসে বাংলাদেশ প্রথম কোভিড-১৯ রোগী চিহ্নিৎ করা হয় এবং ধীরে ধীরে মহামারির প্রভাবে ভাড়া কমতে শুরু করে।”
নব্য-দরিদ্ররা জাতীয় বাজেটের বাইরে?
২০২১-২২ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেট মধ্যবিত্ত এবং মহামারিতে নতুন করে যারা দরিদ্র হয়েছেন তাদের কোনো উপকারে আসবে না বলে মনে করছেন তারা।
ঢাকা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানিয়েছে, রমজানের আগেই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে তাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আতঙ্ক আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আজিমপুরের গৃহবধূ সানজিদা খাতুন বলেন, “বাজেট অনুযায়ী মধ্যবিত্তরা সরাসরি সরকারের সহায়তার বাইরে রয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, "সরকার যদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করতো তবে আমরা উপকৃত হতাম। রমজানের পর থেকেই সবকিছুর দাম আকাশ ছোঁয়া, কোথাও শান্তি নেই।পণ্যের পাশাপাশি মোবাইল ও ইন্টারনেটের বিলও বেড়েছে অথচ আয় বাড়েনি।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অনুষদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “মধ্যবিত্তদের অবহেলা করে দেশ এগিয়ে যাবে এটা ভাবা ঠিক নয়। আগামি ৩০ জুন প্রস্তাবিত বাজেট পাস করা হবে। অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন যা বিবেচনা করা উচিত।"
তিনি আরও বলেন, "বাজেটে চাকরির সুযোগ বা কর্মসংস্থানমুখী ও মহামারিতে যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন তাদের জন্য কার্যকর কোনো কর্মসূচি নেই। তাই এ বিষয়ে আরও আলোচনা ও সংশোধন করার সুযোগ এখনও রয়েছে। মধ্যবিত্ত ও নব্য-দরিদ্রদের জন্য সংশোধিত বাজেটে প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।"