বাংলাদেশে গত বছরের মার্চে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্তের পর ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সে সময় বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢাকা ছেড়ে যাওয়াই দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তারের প্রাথমিক কারণ বলে জানিয়েছে এক গবেষণা।
সম্প্রতি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি), আইদেশি, বাংলাদেশ সরকারের এটুআই প্রোগ্রাম, যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক স্যাঙ্গার জিনোমিক ইনস্টিটিউট, হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ, এবং ইউনিভার্সিটি অব বাথ-এর বিজ্ঞানীদের যৌথ উদ্যোগে মিলে একটি জিনোমিক কনসোর্টিয়ামের আওতায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রবেশ, দেশব্যাপী বিস্তৃতি এবং বিস্তার প্রতিরোধে বিভিন্ন সময়ে লকডাউন ও জনসাধারণের গতিবিধির ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে একটি বিশ্লেষণধর্মী গবেষণাপত্র প্রকাশ করে।
আইসিডিডিআরবি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আজ মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) এ গবেষণার বিষয়ে জানিয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর “নেচার” সাময়িকীতে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। গবেষণায় বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের উদ্ভব, দেশব্যাপী বিস্তারে লকডাউনের আগে ও পরে জনসাধারণের চলাচলের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের এটুআই প্রোগ্রাম থেকে সংগৃহীত ফেসবুক এবং মোবাইল ফোন অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ২০২০ সালের মার্চের ২৩ থেকে ২৬ তারিখের মধ্যে জনসাধারণের ঢাকা ত্যাগের প্রাপ্ত ডাটার সঙ্গে সার্স-কোভ-২ জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে। ওই চার দিনে ঢাকার বাইরে যাতায়াতই মূলত দেশব্যাপী করোনাভাইরাস বিস্তারের প্রাথমিক কারণ।
২০২০ সালের মার্চ মাসে এই গবেষণাটি শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ওই বছরের মার্চ-জুলাই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত করোনাভাইরাসের ৩৯১টি জিনোম বিশ্লেষণ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য উদ্ভব হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে। পরে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের মাধ্যমে আরও ভাইরাসের অনুপ্রবেশ ঘটে।
আইইডিসিআর-এর পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বলেন, “আমাদের এই সমন্বিত উদ্যোগ বিভিন্ন সময়ে নীতিনির্ধারকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকাতে জনসাধারণের চলাচল নিষিদ্ধ করা, পরিবহন এবং যানবাহন চলাচলে সীমাবদ্ধতা আনা, বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন। যেসব দেশে উদ্বেগজনক ভেরিয়েন্ট ছিল, সেখান থেকে আগত ভ্রমণকারীদের সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা রাখা, সময়মতো লকডাউন সিদ্ধান্ত বা প্রয়োজনবোধে আন্তর্জাতিক চলাচল সীমাবদ্ধ করার পরামর্শও দেওয়া হয়। আমাদের এই কনসোর্টিয়াম গত বছরের মার্চ মাস থেকে একত্রে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের এই কাজ চলমান থাকবে। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের নীতিনির্ধারকদের জন্য কোভিড-১৯–এর বিস্তার ঠেকাতে প্রয়োজনীয় প্রমাণভিত্তিক তথ্য সরবরাহ করতে পারব।”
গবেষণা প্রতিবেদনের মূল লেখকদের একজন ড. লরেন কাউলি বলেন, “জেনোমিক এবং মবিলিটি ঢাকা থেকে বিভিন্ন ডাটা স্ট্রিম একত্রিত করে কীভাবে করোনাভাইরাস বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, আমরা তা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছি। এই গবেষণায় মহামারি প্রতিরোধে জিনোম সিকোয়েন্সিং-এর কার্যকারিতা দেখানো হয়েছে, যা ভবিষ্যতে অন্যান্য মহামারির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।’
হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক ক্যারোলিন বাকি বলেন, “মবিলিটি ডাটা প্রথাগত চলমান সার্ভিলেন্স সিস্টেমের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে— এ ধরনের একটি মিলিত বিশ্লেষণধর্মী গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা মূল্যবান ভূমিকা রাখতে পারে, যা অন্য কোনও উপায়ে অর্জন করা কঠিন। এ ধরনের গবেষণা শুধুমাত্র চলমান করোনাভাইরাস মহামারির ক্ষেত্রেই নয়, ভবিষ্যতের যে কোনও মহামারি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।”
আইসিডিডিআর,বি’র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং এই গবেষণায় নেতৃত্ব প্রদানকারীদের অন্যতম একজন ড. ফেরদৌসী কাদরী বলেন, “অনেক প্রতিকূলতা এবং লকডাউনের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমার সহকর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক কোলাবোরেটরদের সহযোগিতায় আমরা সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। আমাদের দায়িত্ব এই গবেষণাতেই সীমাবদ্ধ নয়। পুরো পৃথিবীজুড়েই বিভিন্ন দেশে কয়েক মাস পর মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু ভ্যারিয়েন্ট ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করছে দেশের সব মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার। এই টিকাগুলোর কার্যকারিতা বোঝার জন্য আমাদেরকে এ ধরনের কাজ অব্যাহত রেখে সরকারকে সময়মতো সঠিক তথ্য দিয়ে, প্রযয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করতে হবে।”
গবেষণায় ফেসবুক ডেটা ফর গুড, গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি আজিয়াটা লিমিটেড জনসংখ্যা মোবিলিটি তথ্য সরবরাহ করেছে। বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সার্স-কোভ -২ নমুনার সিকোয়েন্সিংয়ে সহায়তা করেছে।