বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল টাঙ্গাইলের মধুপুর বন। এক সময় বিভিন্ন প্রজাতির বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী থাকলেও কালের বিবর্তনে এবং বনভূমি উজাড় হওয়ায় এ বনে এখন বন্যপাণী কমতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হওয়ার পাশাপাশি অনেক বন্যপাণী বিলুপ্তির পথেও রয়েছে।
বন বিভাগের ভাষ্যমতে, বনের জমি দখল করে আদিবাসীদের ঘর নির্মাণ ও বন্যপ্রাণী হত্যাই বন্যপ্রাণী কমা ও বিলুপ্তির প্রধান কারণ। অন্যদিকে, স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর লোকজন বলছে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বন বিভাগের গাছ কাটার কারণে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমেছে।
বন বিভাগ জানায়, বর্তমানে বন্যপ্রাণী রক্ষায় গাছের চারা লাগানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে টাঙ্গাইল বন বিভাগ। তারই ধারাবাহিকতায় টেকসই বন ও জীবিকা সুফল প্রকল্প এগিয়ে চলছে। এতে বনের ভেতরে বৃক্ষাচ্ছাদন বৃদ্ধি পাবে এবং বন্যপ্রাণীর খাদ্য সংকট নিরসন হবে।
টাঙ্গাইল বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কয়েক দশক আগে মধুপুর বনে চিতা বাঘ, হাতি, বন্য মহিষ, ময়ূর ছিলো। বর্তমানে এ সব প্রাণী আর দেখা যায় না। বর্তমানে যে সব বন্যপ্রাণী রয়েছে সেগুলো সংখ্যাও খুবই কম। বন্য শুকরও এখন বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হনুমান, বানর, মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, শজারু, মেছো বাঘ, বেজী, বন বিড়াল, শেয়াল, খেক শেয়াল, মার্বেল ক্যাট, বাদুর, খরগোশ, কাঠবিড়ালি ইত্যাদি। আগে আরো অনুমানিক ১৫ থেকে ২০টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী ছিলো।
বর্তমানে এ বনে ১৫ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী রয়েছে। উল্লেখযোগ্য সরীসৃপ প্রাণী প্রাণীগুলো হলো- অজগর, গোখরা, গুই সাপ, তক্ষক, লাউ ডোগা সাপ, গোখরো সাপ রয়েছে। আগে আরো ১০-১৫ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী ছিলো। উভচর প্রাণীর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে। সেগুলো হলো, গেছো ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ, সবুজ ব্যাঙ প্রমুখ।
বর্তমানে এ বনে প্রায় ৬০-৭০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এর মধ্যে মাছরাঙা, হুতুম প্যাঁচা, লক্ষ্মী প্যাঁচা, পানকৌড়ি, সাদা বক, চিল, হুদহুদ, সবুজ সুইচোরা, কানাবগি, বালিহাঁস, শকুন, ডাহুক, কাদা খোচা, গাঙচিল, ঘুঘু, গোলাপী ঘুঘু, বুলবুল, কোকিল, কাঠঠোকরা, বনমোরগ, দোয়েল, শালিক, হাঁড়িচাচা বুলবুলি, শ্যামা, টুনটুনি, বাবুই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তথ্য অনুযায়ী, ১৮৬৮ সাল থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত মধুপুর গড় থেকে ৪১৩টি হাতি শিকার করা হয়। ১৯৮৮ সালে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে ভাগ হয়ে টাঙ্গাইল বনবিভাগের সাথে মধুপুরকে যোগ করার পর ওই সময়ে উপভোগী গাছ চুরি করার কারণে পশু ও বন্যপ্রাণীর খাবার কমতে থাকে। এতে বনের ভেতরে থাকা পশুপাখি ও সরীসৃপ প্রাণী কমতে থাকে।
মধুপুর বন ১৯৬২ সালে বনবিভাগের আওতায় আসার পর এ বনের জৈববৈচিত্র সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুসারে, জৈববৈচিত্র সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৮২ সালে এ বনের ৮৪,৩৬৬ হেক্টর জায়গাকে মধুপুর ও ভাওয়াল নামে দুটি জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়।
ঢাকা ট্রিবিউনকে বন বিভাগ জানায়, বন সংরক্ষণের লক্ষ্যে বন উজাড় রোধ ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন ও পশুখাদ্য উপযোগী করার জন্য ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৯,৬২,৫০০টি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আমলকী, হরতকি, বহো, বগডুমুর, কদবেল, মহুয়া, অর্জুন, ডুমুর, বন আলী, আমড়া, বন আম বেওয়া, চাপালিশ, জলপাই, শিমুল, বট, বুতুম, গান্দি গজারী ডায়না উল্লেখযোগ্য।
২০১৮-১৯ সালে জাতীয় উদ্যানে ২০০ হেক্টর ও দোখলা রেঞ্জ এলাকায় ১০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ৩ লাখ গাছের চারা রোপণ করা হয়। ২০১৯-২০ সালে জাতীয় উদ্যানে ১৯০ হেক্টর, দোখলা রেঞ্জে ১৩০ হেক্টর ও মধুপুর রেঞ্জের ৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ৫,৬২৫০০ গাছের চারা রোপণ করা হয়। ২০২০-২১ সালে ধলাপাড়া রেঞ্জে ৭০ হেক্টর, হতেয়া রেঞ্জে ২৩৫ হেক্টর, বহেড়াতলী রেঞ্জে ১০৫ হেক্টর, জাতীয় উদ্যানে ১০৫ হেক্টর, দোখলা রেঞ্জে ১৫০ হেক্টর, মধুপুর রেঞ্জে ৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির মোট ১১ লাখ গাছের চারা রোপণ করা হয়।
প্রতিটি বাগান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৮ সদস্য বিশিষ্ট ফরেস্ট পোটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন কমিটি (এফপিসিসি) করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ফরেস্ট কনভারসেশন ভিলেজ কমিটি (এফসিবি)। অপরদিকে, ৭০০ কমিউনিটি ফরেস্ট ওয়ার্কারকে (সিএফডব্লিউ) ৫ শতাংশ সুদে ৫০ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এদের প্রত্যেককে মাসিক ভাতা বাবদ ১২০০ টাকা দেওয়া হয়।
সরেজমিনে মধুপুর বনে গিয়ে দেখা যায়, বনের ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় সারিবদ্ধভাবে গাছের চারা লাগানো হয়েছে। বনবিভাগের কর্মীরা এ সবের দেখাশোনা করছে। বন্য হরিণের জন্য “হরিণ প্রজনন কেন্দ্র” করা হয়েছে।
কমিউনিটি ফরেস্ট ওয়ার্কার আনিসুর রহমান ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “২০০৩ সালে বিএনপি সরকার ঘোষণা দিয়েছিলো বনের ভিতর কোন আকাঠা গাছ থাকবে না। তারপর থেকে বন থেকে আকাঠা গাছ পাচার হতে থাকে। এতে বন্যপ্রাণীদের খাবারের সংকট দেখা দেওয়ায় এরা লোকালয়ে পেঁপে, আনারস বাগানসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা শুরু করে। তখন স্থানীয় লোকজন বন্যপ্রাণীদের মারা শুরু করে। এভাবে বন্যপ্রাণী কমতে থাকে। যেভাবে ঔষধিসহ বিভিন্ন গাছ রোপণ করা হয়েছে। এ সব গাছের ফল ধরার পর বন্যপ্রাণীর খাবার হবে। ফলে মধুপুর বন আবার পূর্বের মতো বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হবে।”
মধুপুরের দোখলা রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল আহাদ ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। বন্যপ্রাণীর খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য শাল বাগানের ভিতরে ফাঁকে ফাঁকে ফল জাতীয় গাছ রোপণ করা হয়েছে। এ বৃক্ষ গুলোর ফল বন্যপ্রাণীর খাবার হবে। এর ফলে বন্যপ্রাণীদের খাবার সংকট হবে না।”
এ প্রসঙ্গে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “৮০ দশক থেকেই বন্যপ্রাণী কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে আগের মতো প্রাকৃতিক বনায়ন নেই। সামাজিক বনায়নের নামে বনের অনেক গাছ কাটা হচ্ছে। আবার সুফল প্রকল্পের নামে একদিকে প্রাকৃতিক গাছ কাটে, অন্যদিকে গাছের চারা লাগানো হচ্ছে। এসব কারণে বন্যপ্রাণীর খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। যার ফলে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমছে।”
তিনি দাবি করেন, বর্তমানে বনে কিছু বানর, হনুমান, হরিণ, শেয়াল, বেজি, কাঠবিড়ালি, পাখি, বন মোরগ, গুই সাপ, কিছু বিষাক্ত সাপ দেখা যায়। আগে বাঘ, ভাল্লুক, হাতিসহ নানা প্রজাতির প্রাণী ছিলো। মূলত গাছ কাটার কারণে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমছে এবং অনেক প্রাণীই বিলুপ্ত হয়েছে। আগে অনেক বন্যপ্রাণীই আক্রমণ করতো। কিন্তু এখন খাবারের খোঁজে অনেক প্রাণী লোকালয়ে চলে আসে।
তিনি বলেন, “তাদের অনেক আগে থেকেই আমরা এখানে বসবাস করে আসছি। কিছু প্রাণী আমাদের উপর আক্রমণ করলে জীবন রক্ষার্থে অনেক সময় বন্যপ্রাণীকে হত্যা করা হয়ে থাকে।”
এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মুহাম্মদ জামাল হোসেন তালুকদার ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “আদিবাসীরা এটিকে তাদের নিজস্ব জায়গা মনে করে। তারা তাদের মতো করে ব্যবহার করছে। এছাড়া, স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর লোকজন বন্যপ্রাণী খায়। বনের ভিতরে থাকা ফায়ারিং রেঞ্জে ফায়ারিং এর শব্দে বন্যপ্রাণী এলাকায় প্রাণী থাকে না। বন্যপ্রাণীদের নিজস্ব পরিবেশ দিতে হবে। এসব কারণে বন্যপ্রাণী কমছে ও বিলুপ্ত হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশের কোন বনের ভিতরে বাড়ি ঘর নেই। কিন্তু মধুপুর বনের ভিতরে বাড়ি ঘর রয়েছে। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিবে হবে, এই জায়গা টুকু আদিবাসীদের দিয়ে দেবে নাকি, বন বিভাগকে দিয়ে দেবে।”
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “মধুপুর বন বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম। শালবনের মধ্যে মধুপুর বন প্রথম। বনভূমি দখল করে আদিবাসীদের ঘর নির্মাণ করায় ইতিমধ্যে কিছু বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে এবং বর্তমানে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমছে। যেসব বন্যপ্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে সেসব বন্যপ্রাণীকে ফিরিয়ে আনার জন্যই সুফল প্রকল্পের আওতায় ১৯ লাখ গাছের চারা লাগানো হয়েছে। আমরা যদি এই চারাগুলো রক্ষা করতে পারি, তাহলে আবারো মধুপুরে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ফিরে পাবো। এতে বন্য প্রাণী বনের ভিতরেই থাকবে। তখন লোকালয়ে গিয়ে বন্যপ্রাণী সাধারণ মানুষকে কোন সমস্যা ও ক্ষতি করবে না। ঠিক তেমনি মানুষও তখন বন্যপ্রাণীর কোনো ক্ষতি করবে না।”
তিনি আরো বলেন, “১৯৬৭ সালের একটি স্যাটলম্যান্ট ম্যাপে দেখা যায়, বনের ভিতরে তেমন কোন ঘরবাড়ি ছিলো না। তবে তারা বনের ভিতরে জুম চাষ করতো। কালক্রমে তারা জমি দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে। ৪৫,৫৬৫ একর নিয়ে মধুপুর বন গঠিত। এর মধ্যে বর্তমানে আদিবাসীরা ১৯ হাজার একর জমি জবর দখল করে রয়েছে। স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো জমি নেই।”
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক আতাউল গনি ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “বন বিভাগের উদ্যোগে জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য গাছ লাগানোসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন বিভাগকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। বানরসহ বেশ কিছু বন্যপ্রাণী খাদ্যাভাবে ভুগছে। সেই সব বন্যপ্রাণীর খাবারের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। জেলার যেখানেই বন্যপ্রাণীর খাদ্যের অভাব দেখা দিবে সেখানেই সহায়তা দেওয়া হবে। জীব বৈচিত্র্য রক্ষা পেলে আমরা মানুষ বাঁচবো। আমরা সবাই প্রাকৃতিক পরিবেশে সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই।”