পুলিশি সেবার মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসিত সেবা ৯৯৯। এখানে ফোন করে নাগরিকরা আইন-শৃঙ্খলা ছাড়াও আরও কিছু জরুরি সেবা পান। এই নম্বরে ফোন করে আসামি আটক, মাদক কারবারি আটক, নবজাতক উদ্ধার, আত্মহত্যা ঠেকানো, ইভটিজিং ঠেকানো, স্বামীর নির্যাতন থেকে স্ত্রীকে বাঁচানোসহ আরও নানা ধরনের সেবা পাওয়ার খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়।
কিন্তু এই নম্বরে ফোন করে উল্টো হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার একটি ঘটনা এখন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই ঘটনায় পুলিশের তিন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
পুলিশি নির্যাতনের ওই ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ভাইরাল হওয়া এবং তা সংবাদমাধ্যমে প্রচার হওয়ার কারণে ভুক্তভোগীরা হয়তো সাময়িক প্রতিকার পেয়েছেন। কিন্তু সেটা না হলে প্রতিকার পেতেন কি-না সেই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
৮ এপ্রিল যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা এলাকায় একটি পরিবারের সদস্যরা ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা চান। তাদের অভিযোগ ছিল, এক প্রতিবেশী তাদের বাসা থেকে বের হওয়ার পথে দেয়াল তুলে বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই না, তারা গ্যাস ও পানির লাইনও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। কিন্তু ৯৯৯-এ ফোন করার পর পুলিশ গিয়ে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের পক্ষেই অবস্থান নেয়। অভিযোগকারীদের মারধোর করে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়।
এই ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ দুইদিন আগে প্রচার হওয়ার পর যাত্রাবাড়ী থানার এসআই বিশ্বজিৎ সরকার, কনস্টেবল শওকত এবং নবনিতাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আর একজন আনসার সদস্যকে তার বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। পুলিশ ঘটনার অধিকতর তদন্ত করছে।
এর আগে ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ৯৯৯ এ ফোন করে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছিলেন এক নারী। তিনি ৯৯৯-এ এক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে তাকে হয়রানির অভিযোগ করলে পুলিশ গিয়ে উল্টো ওই নারীকে নির্যাতন করে এবং তার বাড়ি ভাঙচুর করে। পরে অবশ্য ওই নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে সাদুল্লাপুর থানার ধাপরহাট পুলিশ ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর নওয়াবুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়।
৯৯৯ ন্যাশনাল সার্ভিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিআইজি তবারক উল্লাহ বলেন, “আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে, যাত্রাবাড়ীর এই ঘটনা এবং গাইবান্ধায় আরেকটি ঘটনায় সেবা চেয়ে উল্টো হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে আমরা আর কোনো বড় ধরনের অভিযোগ পাইনি।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কোনো অভিযোগ গ্রহণ করার পর থানা পর্যন্ত যোগাযোগ করিয়ে দিই। অভিযোগটি নিয়ে অনলাইনে কথা বলে নিশ্চিত হয়েই থানাকে রেফার করি। কিন্তু থানার পুলিশ মাঠ পর্যায়ে কী করবে তা সরাসরি দেখার জন্য তাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা আছে। তবে আমরাও ফলোআপ করি। যাত্রাবাড়ীর ঘটনায় আমরাও জবাবদিহি করেছি। আমাদের দিক থেকে কোনো ত্রুটি ছিল না।”
২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় জরুরি সেবার আওতায় এই ৯৯৯ সার্ভিস চালু হয়। এ পর্যন্ত তিন কোটি ১২ লাখ ৫২ হাজার নাগরিক ৯৯৯-এর সেবা পেতে কল করেছেন। এর মধ্যে জরুরি বিবেচনায় ৬৬ লাখ ৭৪ হাজার নাগরিককে সেবা দেওয়া হয়েছে। যা মোট কলের ২১%। বাকি কলগুলো ছিল গুরুত্বহীন।
সাধারণত পুলিশি সহায়তা, জরুরি পুলিশি সহায়তা, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স-এই চার ধরনের জরুরি সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। মোট ১০০টি ডেস্কের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হয় ৯৯৯-এর মাধ্যমে। জনবল রয়েছে ৫০০।
অতিরিক্ত ডিআইজি তবারক উল্লাহ বলেন, “আমাদের পুরো সার্ভিসটাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হয়। ফলে এখানে কোনো ব্যত্যয় হলে তা সহজেই চিহ্নিত করা যায়। মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা সেবা দিতে গিয়ে কিছু সমস্যা করেন। তবে আমাদের কাছে সে ব্যাপারে যে অভিযোগ আসে তা খুবই অল্প। আর পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের অভিযোগ আমরা ৯৯৯-এর মাধ্যমে পাই। আমরা সেই অভিযোগ তাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দেই।”
৯৯৯-এর কারণে পুলিশি সহায়তা পাওয়া মানুষের জন্য সহজ হয়ে গেছে। আর এটা সারাদেশে কাজ করে। সাধারণ মানুষ সরাসরি থানায় যেতে অনেক সময় ভয় পান বা ইতস্তত বোধ করেন। ৯৯৯ সেটা সহজ করে দিয়েছে।
তবারক উল্লাহ বলেন, “আমরা কোনোভাবেই কোনো ব্যক্তি বা কোনো ক্ষুদ্র ইউনিটের জন্য এই সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে দেব না। এজন্য পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সতর্ক আছে। আমরা কাউন্সেলিং করি এবং এটা অব্যাহত থাকবে। আর ৯৯৯-এর সার্ভিস সব সময় অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে।”
যাত্রাবাড়ী এলাকাটি পুলিশের ওয়ারী বিভাগের অধীনে। ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, “আমি মনে করি যাত্রাবাড়ীর এই একটি ঘটনার জন্য ৯৯৯-এর ওপর নাগরিকদের আস্থা কমবে না। বরং এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে এবং বাড়বে। এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। অভিযুক্তদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদন দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে তিনি দাবি করেন, যাত্রাবাড়ীতে ৯৯৯-এ যারা ফোন করেছেন তাদের মধ্যে একজন আছেন মামলার আসামি। পুলিশ হয়তো আসামি সামনে আসায় আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে কোনো জটিলতা করেছে। অভিযোগকারীরা পুলিশের ওপর ঘরের মধ্যে হামলা করেছে যা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আসেনি।
তবে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য শিল্পী আক্তার বলেন, “জমি নিয়ে আমাদের সঙ্গে প্রতিবেশী নুরুল ইসলামের মামলা ও আদালতের অর্ডার আছে। তারপরও তিনি রাস্তায় দেয়াল তুলে দেন। আমরা সকাল থেকে মোট চারবার ৯৯৯-এ ফোন করি। প্রতিবারই বিশ্বজিৎ সরকার এসে দেয়াল নির্মাণ বন্ধ না করে উল্টো আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। শেষবার এসে তিনি আমাদের প্রতিপক্ষ নুরুল ইসলামের লোকজন নিয়ে ঘরে ঢুকে আমাদের মারধোর করেন। পুলিশ আমার বোন ও বাবাকে যে মারধোর করেছে সেটা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আছে। তারা আমাদের ধরে থানায় নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়। আগে কোনো মামলা ছিল না।”