অনুমতি ছাড়াই বাংলাদেশজুড়ে চলছে হাজার হাজার হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এজন্য প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত দুই দিনে সারাদেশে প্রায় ৯০০ অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বন্ধ করে দেওয়া ক্লিনিক ও হাসপাতালের সংখ্যা সারাদেশে যে পরিমাণ অনুমোদনহীন হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে এর তুলনায় সামান্য বলে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে।
আর বাংলাদেশে যত বৈধ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আছে অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। ঢাকার অদূরে সাভার ও আশুলিয়ায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৪০টি। কিন্তু সে এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আছে ১১৭টি।
সাভার বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল হালিম বলেন, “ওই ৪০টি ক্লিনিকই আমাদের সদস্য। বাকি যে আরও শতাধিক ক্লিনিক আছে তাদের আমরা সদস্যপদ দেইনি। কারণ তাদের কারুরই লাইসেন্স নাই। কিন্তু তারা বছরের পর বছর ধরে ক্লিনিক চালাচ্ছে। এমনকি এক রুমের ঘর ভাড়া নিয়েও কেউ কেউ ক্লিনিক খুলে বসেছেন। হাতুড়ে ডাক্তার আর নার্স দিয়ে চালাচ্ছেন।”
তিনি বলেন, “এরা কেউ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ক্লিনিক চালান। আবার কেউ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেই ক্লিনিক চালু করে দেন।”
এটা কীভাবে সম্ভব হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা সবাই জানে। আমি আর কী বলব। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরেই ওইসব অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতাল বন্ধের দাবি করে আসছি। আমরা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান করেও বন্ধ করতে পারিনি।”
তবে আরেকজন ক্লিনিক মালিক অভিযোগ করে বলেন, “স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু কর্মকর্তা এবং পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় এইসব অবৈধ ক্লিনিক চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মাঝে সাময়িক বন্ধ করে দিলেও কয়েকদিন পর সমঝোতার ভিত্তিতে আবার চালু হয়।
কত বৈধ, কত অবৈধ?
সারাদেশে বৈধ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৫৫টি। আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে ছয় হাজারের মত। ১২ হাজার লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিপরীতে অবৈধের সংখ্যা ১২ হাজারেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। আর সরকারের এই অভিযানে এমন ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে।
যেমন সাভারে বৈধ ক্লিনিকের চেয়ে অবৈধ ক্লিনিক প্রায় তিনগুণ বেশি। ময়মনসিংহেও একই অবস্থা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিত্র সবখানেই প্রায় একই রকম বলে জানা গেছে।
বরিশালে অবৈধ ক্লিনিক নিয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে রবিবার হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা।
এদিকে, উদ্বেগ শুধুমাত্র অনুমোদনহীন ক্লিনিক বা হাসপাতাল নিয়েই নয়। কেননা বৈধ ক্লিনিকেরও একটি অংশ মানসম্পন্ন নয় বা লাইসেন্সের শর্ত পূরণ করছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. বেলাল হোসেন বলেন, “আমরা অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক নিজেদের উদ্যোগেই বন্ধ করার জন্য ৭২ ঘণ্টার সময় বেধে দিয়েছিলাম। সেটা শেষ হওয়ার পর দুই দিন ধরে সারাদেশে অভিযান শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা ৮৮২টি বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। অবৈধ ক্লিনিক-হাসপাতালের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। তবে সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব নয়।”
এদিকে, অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স থাকলেও তারা শর্ত মানছে না। অনেকের লাইসেন্সও নবায়ন করা নেই। লাইসেন্স দেওয়া হয় এক বছরের জন্য, এক বছরের পর আবার নবায়ন করতে হয়।
আরও পড়ুন- দেশে ৮৮২টি অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের একজন সাবেক পরিচালক জানান, ঢাকা ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ক্লিনিকের লাইসেন্স যখন দেওয়া হয় তখন ডাক্তার, নার্স, যন্ত্রপাতি ভাড়া করে আনে মালিক কর্তৃপক্ষ। সেটা দেখিয়ে তারা লাইসেন্স নেয়। ফলে অনেক ক্লিনিকই বাস্তবে শর্ত পূরণ করে না। এটা পরিদর্শক দলও জানে। সমঝোতার ভিত্তিতেই হয়।
হাসপাতাল ও ক্লিনিক করার শর্ত
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, হাসপাতাল বা ক্লিনিকের লাইসেন্স পেতে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। ১০ শয্যার একটি ক্লিনিকের লাইসেন্স পেতে হলে ওই ক্লিনিকে কমপক্ষে তিনজন এমবিবিএস ডাক্তার, ছয়জন নার্স ও দুইজন ক্লিনার থাকতে হবে।
প্রত্যেকটি বেডের জন্য কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা থাকতে হবে। অপারেশন থিয়েটার হতে হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেইসঙ্গে আধুনিক যন্ত্রপাতি যা থাকতে হবে তার একটি তালিকাও দেওয়া আছে। এর সঙ্গে থাকতে হবে ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন নম্বর, বিআইএন নম্বর, পরিবেশ ও নারকোটিকস বিভাগের লাইসেন্স।
আউটডোর, জরুরি বিভাগ ও অপারেশন থিয়েটার সব ক্লিনিকের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। হাসপাতালের ধরন অনুযায়ী শর্ত নির্ধারণ করা হয়।
হাসপাতাল বা ক্লিনিকের লাইসেন্সের আবেদন করার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল সরেজমিন তদন্ত করে লাইসেন্স প্রদান করেন। লাইসেন্সের শর্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একই তবে লাইসেন্স ফি প্রদানে পার্থক্য রয়েছে। এক ইউনিটের একটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সর্বনিম্ন ১০টি শয্যা থাকতে হবে। শয্যা সংখ্যা বেশি হলে আনুপাতিক হারে জনবল এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যা করছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. বেলাল হোসেন মানহীন ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোকে সতর্ক করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “তাদেরও একটি সময় বেধে দেওয়া হচ্ছে। সেই সময়ের মধ্যে তারা সবকিছু ঠিকঠাক না করলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন যেগুলো বন্ধ করা হচ্ছে তাদের লাইসেন্স তো দূরের কথা সাধারণ ট্রেড লাইসেন্সও নাই।”
অনুমোদানহীন ক্লিনিক ও হাসপাতাল এতদিন কীভাবে চলেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এতদিন চলেছে এখন বন্ধ করা হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো আমরা বন্ধ করছি।” আর এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তার অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান।
বাংলাদেশ বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সভাপতি ডা. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, “আমাদের সদস্য সংখ্যা ১১ হাজার। তারা সবাই লাইসেন্সপ্রাপ্ত। তবে অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা এই অভিযানকে স্বাগত জানাই।”
তিনি দাবি করেন, “যাদের লাইসেন্স আছে কিন্তু শর্ত পূরণ করছে না তাদের অবৈধ বলা যাবে না। তবে তাদের শর্ত পূরণের জন্য মনিটরিং-এর আওতায় আনা দরকার।” তার কথা, “অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে যাদের লাইসেন্স নাই, ডাক্তার নাই, নার্স নাই। তারা এতদিন কীভাবে টিকে আছে এই প্রশ্ন আমাদেরও।”