রাজশাহীতে অনেক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অব্যবস্থাপনার চিত্র বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে এসেছে অনেক আগেই। কিন্তু এই নিয়ে কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা দেখা যায়নি কখনও। নিয়ম অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনের কথা থাকলেও তা ঠিকমতো নজরদারির আওতায় আসেনি। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর হঠাৎই রাজশাহীতে তৎপরতা শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার পর রাজশাহী বিভাগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ১৩৫টির মতো অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এখনও চলছে অভিযান। বিভাগে অবৈধের তালিকায় ১৬৪টির মতো ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক রয়েছে। যেগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। কিন্তু কেন এতদিন অভিযান চালানো হয়নি? রুটিন ওয়ার্ক হলেও কেন বসে ছিল সংশ্লিষ্ট দপ্তর? এসব প্রশ্নই ঘুরছে জনমনে।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিভাগে বৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা এক হাজার ৪৪৩টি। এর মধ্যে রাজশাহী জেলায় রয়েছে ২৮৬টি। প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএইচসিডিওএ) আওতায় রাজশাহী নগরীতে ১৩০টি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। বিপিএইচসিডিওএ’র নেতৃবৃন্দ দাবি করছেন, তাদের প্রত্যেকের নিবন্ধন রয়েছে। তবে এই সংগঠনের বাইরেও শুধু নগরীতেই আরও অনেক ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।
লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি- এমন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করার খবরে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিপিএইচসিডিওএ’র রাজশাহী শাখার নেতারা। সোমবার (৩০ মে) রাতে সংবাদ সম্মেলন করে আট দফা দাবি উত্থাপন করেছেন।
বিপিএইচসিডিওএ’র রাজশাহী শাখার সহ-সভাপতি ড. ফয়সাল কবির চৌধুরী দাবি করেন, “যে পন্থায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার বিবেচনা করছেন তা অন্যায়। নিবন্ধন নিতে বা নবায়ন করতে একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় আট ধরনের লাইসেন্স নিতে হয়। এই লাইসেন্স সংগ্রহ করতে দুর্ভোগ ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণেই অনেক ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার আবেদন করেও নবায়ন করতে পারছে না।”
তার অভিযোগ, লাইসেন্স নবায়ন না হওয়ার জটিলতার দায়ভার সম্পূর্ণভাবে রাজশাহী সিভিল সার্জনের ওপর বর্তায়। একাধিক প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও সিভিল সার্জন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে রিপোর্ট দেন না। সাংগঠনিকভাবে তিনি রাজশাহী সিভিল সার্জনকে অযোগ্য মনে করেন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালকে কেন্দ্র করে এই এলাকার আশপাশে ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কারণে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবাও অনেক সময় ব্যাহত হয়। রোগী বাগিয়ে নিতে দালালদের দৌরাত্ম্যও কম নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক জানান, সরকারি হাসপাতালের আশপাশে গড়ে ওঠা ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠানের সেবার মান ভালো। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে। ভুল রিপোর্ট দিচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, “ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সেবার মান কেমন এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই সরকারি মেডিক্যাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিয়ে যেতে দালাল রাখে। যাদের দৌরাত্ম্য কিছুদিন পরপরই বাড়ে। এ কারণে হাসপাতালের অভ্যন্তরেও নিরাপত্তা জোরদার করতে হয়।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের অভিযান অবশ্যই ভালো। কিন্তু হঠাৎ অভিযান চলে, পরে আর দেখা নেই। এমনটা না করে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর অভিযান চালালে সাধারণ রোগীরা উপকৃত হবে।”
রাজশাহী বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আসাদুজ্জামান জানান, “উপজেলায় ২৫টি বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এদের বেশিরভাগের লাইসেন্সের মেয়াদ নেই। পরিদর্শন করে লাইসেন্স নবায়ন করে দেওয়া সম্ভব হয়নি। যারা লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করে রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে আপাতত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।”
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল রানা বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক অবৈধ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। যতদিন এগুলো বন্ধ করা সম্ভব না হবে, ততদিন অভিযান চলমান থাকবে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার সব ক্লিনিকে এই অভিযান চলানো হবে।”
রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, “নিবন্ধন নীতিমালা মেনে ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার বৈধতা পায়। এর ব্যত্যয় হলেই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পূর্বে অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়নি বিষয়টা এমন না। তবে এখন তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।”
রাজশাহী বিভাগীয় (স্বাস্থ্য) পরিচালক ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, “চোর কাউকে বলে চুরি করে না। তেমনই অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোও ওইভাবেই গজিয়ে উঠেছে, তাদের তালিকা প্রস্তুত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আর যারা নবায়ন করেননি, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “অনেক প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের আবেদন করার পর আর কোনও যোগাযোগ করেনি। খোঁড়া অজুহাত দিয়ে নিবন্ধন নবায়ন করা থেকে বিরত থাকছে। এ কারণেই কেন্দ্র থেকে এমন সিদ্ধান্ত এসেছে। আর যারা নিবন্ধনের আবেদন করেছেন বলছেন- তাদের অধিকাংশের সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি দফতর যেমন- পরিবেশ অধিদফতর, শ্রম অধিদপ্তর এসবের লাইসেন্স নেই। এখন কেউ পরিবেশের নিয়ম না মেনে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিয়োগ না দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাবে- আর লাইসেন্স প্রত্যাশা করবেন এটা হতে পারে না। নিবন্ধন পেতে বা নিবন্ধন নবায়ন করতে আগে শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। অন্যথায় সেবা দিতে গিয়ে রোগী মারবেন, ওই প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়া হবে না।”