বাংলাদেশে ডেঙ্গুর শঙ্কা বাড়ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবার ডেঙ্গু গত বছরের চেয়েও প্রকট হবে। মৌসুমের শুরুতেই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় দেখা যাচ্ছে। আর বৃষ্টি শুরু হলে জুন থেকে অক্টোবরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
এদিকে ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে। এর কোনো বর্ষা বা শীত নেই। ৩১ ডিসেম্বর তীব্র শীতে একদিনে ভর্তি হয়েছেন ৪৭ জন।
ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার ওপর জরিপ এবং হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার- দুটিই খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন ১২ মাসই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কারণ বৃষ্টির বাইরেও উন্নয়নমূলক কাজসহ নানা কারণে এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১,০৮২ জন। মারা গেছেন ১২ জন। ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। সারা দেশে মোট ভর্তি রোগীর ৩৯০ জনই ঢাকায়। মারা গেছেন ৯ জন। এরপরই চট্টগ্রামের অবস্থান। চট্টগ্রামে এই বছর হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২২৮ জন। মারা গেছেন তিনজন।
২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। মারা গেছেন ২৮১ জন। ২০২১ সালে মোট ভর্তি হয়েছিলেন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। মারা যান ১০৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকার চেয়ে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এডিস মশার উপস্থিতি বেশি। যেসব বাড়িতে এডিস মশা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ৩৯.৮% বহুতল ভবন এবং ৩২% নির্মাণাধীন ভবন।
২০২২ সালে এটা ছিল গড়ে ১১%। ঢাকার ৪%-এর বেশি বাড়িতে এডিস মশার উপস্থিতি রয়েছে। আর এই এডিস মশাই ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার ১০৮টি ওয়ার্ডে চালানো হয় এই জরিপ। এর মধ্যে উত্তর সিটির ৪০টি এবং দক্ষিণ সিটির ৫০টি ওয়ার্ডের তিন হাজার ১৫০টি বাড়িকে জরিপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই জরিপের সঙ্গে যুক্ত কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, “গতবারের চেয়ে এবার এডিস মশার ঘনত্বটাও একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে এই জরিপে আসল চিত্র পাওয়া যায়নি। কারণ ওই সময়ে বৃষ্টি ছিল না। আমরা এই মাসের (মে) শেষ দিকে আরেকটা জরিপ করব, সেটায় আরও প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।”
তার কথা, “এখন আর বৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। ভবন নির্মাণসহ নানা কাজে সারা বছরই পানি জমিয়ে রাখা হয়। তাই যখন মৌসুম নয়, তখনও এডিস মশা পাওয়া যায়। ডেঙ্গু এখন তাই সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে।”

মশা মারার ভুল পদ্ধতি
প্রতিবছর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাজেটে মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে। গত ছয় অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কর্পোরেশন ব্যয় করেছে প্রায় ৩৮৭ কোটি টাকা। তবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম সম্প্রতি নিজেই স্বীকার করেছেন রাজধানীর মশা নিধনে এতদিন যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটি ভুল ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের মায়ামি শহরে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে ঢাকায় এসে তিনি বলেন, “আমরা এতদিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। এতে মশা ধ্বংস হয়নি, বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। আমরা মায়ামিতে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা ঢাকায় মশা নির্মূলে কাজে লাগাতে চাই।”
২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই সিটি কর্পোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ রেখেছে ১৪৭ কোটি টাকা। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ ১০১ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন রেখেছে ৪৫.৭৫ কোটি টাকা।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এরইমধ্যে তাদের মশক নিধন পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছে। উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, “আমরা আমাদের কীটবিদের পরামর্শে লার্ভিসাইডিংয়ের সময় পরিবর্তন করে সকাল ৮টার বদলে ভোর ৬টা থেকে শুরু করেছি। কেননা সূর্যের উত্তাপ যত বাড়ে লার্ভাগুলো পানির নিচে চলে যায়, তাতে ওপরে লার্ভিসাইডিং করলে কার্যকারিতা পাওয়া যায় না।”
তিনি বলেন, “আর বায়োলজিক্যালি মশা কন্ট্রোল করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি, এতে পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি হয় না। এছাড়া ডেঙ্গুর লার্ভা ধ্বংসে এলাকাগুলোর জলাশয় ও ড্রেনে গাপটি মাছও ছাড়া হচ্ছে।”
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সচেতনতার ওপর বেশি জোর দিয়েছি। আগে যেটা মাইক ভাড়া করে রিকশায় রিকশায় মাইকিং করাতাম, সেটার বদলে এখন প্রত্যেক ওয়ার্ডের জন্য হ্যান্ডমাইক কিনে দেওয়া হয়েছে। সকালে যেখানে যখন স্প্রে করা হচ্ছে, সেখানে একই সময়ে মাইকিংও করা হচ্ছে। তারাই আবার লিফলেটও বিতরণ করছেন।”
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন আগের পদ্ধতিতেই আছে।

ডেঙ্গু এখন সারা বছর
কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, “২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর ডেঙ্গু এখন সারা বছরই হচ্ছে। এর কারণ ডেঙ্গুর যে বুনো এডিস মশা সেটাও বাড়ছে। এই মশা গাছের কোটরে স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নেয়। আবার এখন গ্রামেও উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। তাই সারা বছর গ্রামেও স্বচ্ছ পানি জমিয়ে রাখা হয়। ফলে বর্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বর্ষায় প্রকোপ বাড়ে।”
“আর শহরে বিশেষ করে ঢাকা সিটিতে শুধু বাসা-বাড়ি নিয়েই কথা বলা হয়। কিন্তু বহুতল ভবন নির্মাণসহ উন্নয়নমূলক কাজের কারণে ওইসব এলাকা এডিস মশার প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে সারা বছরই,” বলেন তিনি।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, “আমরা তো এবার শীতকালেও ডেঙ্গু দেখেছি। ডেঙ্গু এখন শুধু শহরকেন্দ্রিক রোগ নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা। সারা বছরই সচেতন থাকতে হবে। স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা জন্মায়। তাই তিন দিনের বেশি পানি জমতে দেওয়া যাবে না। মশার প্রজনন ধ্বংসে প্রশাসনসহ সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।”
তার মতে, “এর চিকিৎসা নিয়ে কোনো সংকট নেই। লক্ষণ দেখে চিকিৎসা করতে হয়। জ্বর হলে নিজ থেকে প্যারাসিটামলের বাইরে কিছু সেবন করা যাবে না। তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তবে রোগী বেড়ে গেলে চিকিৎসার চাপ তো বাড়বে।”
চট্টগ্রামের ডেঙ্গু পরিস্থিতি
চট্টগ্রামেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। ২০২২ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৪১৭ জন। মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, “বৃষ্টি শুরু হলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। কারণ এখানে সিটি কর্পোরেশন মশক নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কাজ করছে না। অনিয়ন্ত্রিত উন্নমনমূলক কাজ হচ্ছে, যা এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করছে। চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি এলাকায় উচ্চ হারে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে।”
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, “এবার ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। আমরা এক গবেষণায় দেখেছি, ঢাকা শহরের মানুষের ডেঙ্গু নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। তারা জানেন, কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজ করেন না। তারা গ্যারেজে পানি জমে থাকলেও পরিষ্কার করছেন না।”
“আসলে এই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দরকার বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা। শুধু ওষুধ ছিটিয়ে, ফগিং করে হবে না। এটা আমরা অনেক আগেই সরকারকে বলেছিলাম। এখন হয়তো উত্তর সিটি কর্পোরেশন বুঝতে পেরেছে। কিন্তু দক্ষিণ সিটি তো এখনো বোঝেনি।”