দীর্ঘদিন ধরে কিশোরী-তরুণীদের ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিও হাতিয়ে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে আসছিল একটি চক্র। পরে তাদের কাছে অর্থ দাবি করত তারা। অর্থ দিতে না পারলে ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ডে বাধ্য করা হতো ভুক্তভোগীদের।
রবিবার (২২ মে) এক ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।
তিনি জানান, চক্রটির প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ভুক্তভোগীদের নাম-পরিচয় ও ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দেওয়া হতো। এছাড়াও আপত্তিকর ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করে কোটি টাকা আয় করত তারা।
চক্রটির মূলহোতাসহ নয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। তারা হলেন- মার্ক-সাকারবাগ ওরফে আবু সায়েম, শাহরিয়ার আফসান অভ্র, বোগদাদী শাকিল, ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান, জসিম, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তূর্য ওরফে মারুফ ও মিয়া ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট।
সিআইডি প্রধান জানান, “মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলোর ক্রেতারা গ্রুপটির সদস্য হতো। তারা মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে এসব ছবি-ভিডিও কিনে সংরক্ষণ করতো। এই চক্রটির নেতৃত্ব দেয় মার্ক-সাকারবাগ। তার নাম আসল নাম আবু সায়েম। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বয়স ২০ বছর, ঠিকানা চট্টগ্রাম। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
তিনি আরও জানান, আরাফাত নামে এক ভুক্তভোগীর প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি টেলিগ্রাম গ্রুপে ছড়িয়ে দেয় সায়েম। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ডিএমপির তেজগাঁও থানায় পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করা হয়। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে সায়েমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীর হাউজিং এলাকা থেকে অভ্র এবং উখিয়া থেকে শাকিলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিআইডি প্রধান জানান, “তবে বর্তমানে কন্টেন্টের জন্য চক্রটির খুব বেশি কষ্ট করতে হতো না। কারণ, ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকরাই নতুন নতুন কন্টেন্ট তাদের দিতো। প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত সাবেক প্রেমিকরা ক্যামেরাবন্দি করতো, প্রতিশোধের নেশায় সেগুলোই তুলে দিতো ওই চক্রটির হাতে। সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে, ৩০-৪০ সেকেন্ডের প্রোমো বানিয়ে আপলোড করা হতো। প্রমো দেখে যারা ফুল-ভার্সন দেখতে চাইত, তাদের এক থেকে দুই হাজার টাকার প্রিমিয়াম সার্ভিস কিনতে হতো।”
তিনি আরও বলেন, “সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পেজের অ্যাডমিনদের আসল পরিচয় উদ্ধার করা হয়। সায়েমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। তাকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সঙ্গে তার সহযোগী জসিমকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সায়েম এবং মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রুপগুলোর অনেক অ্যাডমিন ঢাকায় অবস্থান করছে। তাদের গ্রেপ্তারে বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেট টুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেপ্তার হয় অ্যাডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তূর্য ওরফে মারুফ এবং মিয়া ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট।”
সিআইডি প্রধান জানান, চক্রটির গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোতে সাবস্ক্রাইবের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। সেগুলোতে আপত্তিকর ভিডিও প্রায় ২০ হাজার। অপরদিকে মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা ফি দিয়ে তাদের প্রিমিয়াম গ্রুপের সদস্য হয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রায় ২,৭৫০ জন।
ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেক ভুক্তভোগী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলেও জানিয়েছেন মোহাম্মদ আলী মিয়া। তিনি বলেন, “এ ঘটনায় কেবল টেলিগ্রাম চক্রের হোতারাই নয়, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাদের সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনা যাবে।”