সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৩২% মেডিকেল শিক্ষার্থী ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে নিজেকে প্রতারক ও অযোগ্য ভাবার প্রবণতা রয়েছে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব কিছুটা বেশি।
বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা ও নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড ও ইউনিভার্সিটি অব সিডনির একদল বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি এ গবেষণা চালান।
গবেষণায় পাওয়া ফলাফল ব্রিটিশ প্রকাশনা এফ১০০০ রিসার্চ জার্নালে “ডিস্ট্রিবিউশন অব ইমপোস্টার সিনড্রোম অ্যামাং মেডিকেল স্টুডেন্টস অব বাংলাদেশ: আ ক্রস সেকশনাল স্টাডি” শীর্ষক এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।
ইমপোস্টার সিনড্রোমে আক্রান্তরা নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে অন্যের ধারণাকেও অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন। এর ফলে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়। একই সঙ্গে আতঙ্ক তৈরি হয় যে, তাদের অযোগ্যতা ও সীমাবদ্ধতার কথা মানুষ জেনে যাবে।
রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ৫০০ মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীর মধ্যে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, পুরোপুরি অমূলক হলেও মেডিকেল কলেজের সব বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই এখন এ ধরনের বিশ্বাস ও আতঙ্ক কম বেশি কাজ করছে।
গবেষণায় দেখা যায়, দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজের প্রায় ৩৬% ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের প্রায় ২৯% শিক্ষার্থীর মধ্যে ইমপোস্টার সিনড্রোম বা নিজেকে প্রতারক ভাবার প্রবণতা রয়েছে। গড়ে এ হার দাঁড়ায় ৩২% এর কিছু বেশি।
মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ২৭%, দ্বিতীয় বর্ষের ১৯, তৃতীয় বর্ষের ৪০%, চতুর্থ বর্ষের ৪০% ও পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ৩৮% এর মধ্যে নিজেকে প্রতারক মনে করার প্রবণতা রয়েছে।
এছাড়া ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে ইমপোস্টার সিনড্রোমের প্রাদুর্ভাব কিছুটা বেশি। ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের তুলনামূলক বাড়তি উদ্বেগে ভুগতে দেখা যায়। আবার পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে পরিশ্রম করার প্রবণতাও তাদের মধ্যে বেশি।
মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক।
তিনি বলেন, ‘‘মেডিকেলের পাঠ্যক্রম অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাভীতি কাজ করে। তাদের মধ্যে শিক্ষক ও পরীক্ষকভীতিও রয়েছে। এ ভীতিকর পরিবেশে তারা মানিয়ে চলতে পারে না। এছাড়া দেশে প্রতি বছর অনেক চিকিৎসক বের হচ্ছেন, কিন্তু সে তুলনায় সরকারি বা বেসরকারি কর্মসংস্থান নেই। শিক্ষার্থীরা এমবিবিএস শেষ করে কোথায় কাজ করবেন তা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে ভোগেন। শিক্ষার্থীরা যেসব মেডিকেল কলেজে শিক্ষাগ্রহণ করছেন, সেখানকার নানা সীমাবদ্ধতাও তাদের হীনম্মন্যতা ও ভীতি তৈরিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।’’
এছাড়া পরিবারের আয়ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইমপোস্টার সিনড্রোমের প্রাদুর্ভাবে বড় ভূমিকা রাখে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
আয়ভিত্তিক বিভাজনে দেখা গেছে, মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার কম, এমন পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪২.৯% এ সমস্যায় ভুগছেন।
গবেষকদের অন্যতম মো. শাহজালাল বলেন, ‘‘আমরা মূলত দেখার চেষ্টা করেছি, মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইমপোস্টার সিনড্রোমের প্রভাব কেমন। এ গবেষণার ফলাফল আমলে নিয়ে পরবর্তী সময়ে কেউ আরও বিস্তর গবেষণা করতে পারবেন। সেখানে হয়তো উঠে আসবে কী কারণে এমন হচ্ছে।’’
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘দেশের সরকারি ও বেসরকারি অনেক মেডিকেল কলেজে শিক্ষকস্বল্পতা রয়েছে। একই সঙ্গে ঘাটতি রয়েছে অবকাঠামোগত বিষয়গুলোতেও। দেশে ১৬ কোটি মানুষের প্রতি এক হাজারের জন্য একজন করে চিকিৎসক দরকার হলেও ১ লাখ ৬০ হাজার চিকিৎসক প্রয়োজন। এতো চিকিৎসক দ্রুত তৈরি করার ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক সব সহযোগিতা প্রয়োজন। মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা সে সহযোগিতা পাচ্ছেন না।’’