দিনের আলো ফোটার আগেই কুষ্টিয়ার মিরপুরে ভিড় করতে শুরু করেছেন কিছু মানুষ। সময় যতো গড়াচ্ছে ভিড় ততোই বাড়ছে। একটা সময় মিছিলের মতো হাজার হাজার মানুষ। এই মানুষেরা কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেননি। কোনো প্রতিবাদের জন্যও জড়ো হননি। তাদের সমাবেশের উদ্দেশ্য ভিন্ন। পরিবার নিয়ে টিকে থাকার লড়াই করতে সেই কাকডাকা ভেরে বিছানা ছেড়ে, সমস্ত সুখের বিসর্জন দিয়ে ছুটে এসেছেন এই হাটে।
তারা সবাই শ্রমিক। আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার সময়ে, মানুষের সহজ অথচ স্বাচ্ছন্দ্যের আয়েশি জীবনযাপনের সময়ে তারা কেউ কৃষিকে সচল করতে, কেউ সভ্যতা নির্মাণের ব্রত নিয়ে জড়ো হয়েছেন। তারা কাজ করতে চান ক্ষেতে, খামারে, গৃহস্থালিতে। তারা ফসল বুনতে চান বা ঘরে তুলতে চান। তারা অন্যদের জীবনকে একটু সুখি করতে চান। তাদের আর অন্যকিছু চাওয়া নেই।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছাড়াও পাশ্ববর্তী দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার লোকজন এখানে আসেন কাজের খোঁজে। এক বেলার জন্য শ্রম বিক্রি করেন তারা। তবে বর্তমানে শ্রমিকের হাটে এখন যেন হতাশা। প্রতিদিন সূর্যের তীব্র রোদের মধ্যে ঘামে ভিজে অন্যের ক্ষেতখামারে কাজ করলেও তাদের উপার্জন বাড়েনি। বাড়তি শ্রম দিয়েও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত পারিশ্রমিক। চাল-ডাল সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও বাড়েনি নিম্নআয়ের মানুষের শ্রমের মূল্য। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের শ্রমিক শফিকুল ইসলাম বলেন, “হাড়ভাঙা পরিশ্রক করেও এখন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। এই টাকায় সংসার চলে না। খাওয়া খরচ বাদেও দুই ছেলের লেখাপড়াসহ অনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।”
দৌলতপুর এলাকা থেকে আসা শ্রমিক মিজান মণ্ডল, রহিম ও আবদুল খালেকরা জানান, বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি বেড়েছে প্রতিটি নির্মাণসামগ্রীর দামও। তবে আমাদের মতো প্রতিদিনের শ্রমিকদের শ্রমের পারিশ্রমিক বাড়ানো হয়নি।
তারা বলেন, “পরিবার নিয়ে আমরা মরে গেলে কার কী? আমাদের মতো গরিব মানুষকে চোখে পড়ে না। শ্রমিকের পারিশ্রমিক বাড়াতে আমি একা যদি প্রতিবাদ করি বা বলি আমাকে হাজিরার টাকা বেশি দিতে। তাহলে কাল আর আমাকে কেউ কাজে নেবে না।”
আগের সময়ে বাজারে গেলে ৩০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কেনা যেত এখন কিন্তু সেই একই পণ্যের জন্য খরচ হচ্ছে প্রায় ৭০০ টাকার বেশি। তবে আমাদের দিনের কাজের পারিশ্রমিক ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।
একই এলাকার হাসান আলী বলেন, যদি একদিন কাজ না আসি আমাদের মুখে খাবার জোটে না। তাই নিম্নআয়ের মানুষকে বাঁচতে চাইলে দ্রুত বাজার সামলাতে হবে। বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা জরুরি।”
আব্দুল কাদের বলেন, “বেলা বাড়লে শ্রমিকের মূল্য আনুপাতিক হারে কমতে থাকে। এছাড়াও সারাদিন না খেয়ে কাজ করার পারিশ্রমিক ও একবেলা খাবার দিয়ে কাজ করার পরিশ্রমিকের মধ্যে পার্থক্য আছে। অনেক সময় খাবার দিলে মজুরি কিছুটা কম দেয়।”
স্থানীয় ব্যবসায়ী রাজিবুল ইসলাম বলেন, “প্রতিদিন শ্রমিকরা কাজের জন্য বাজারে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। এখান থেকে তারা বিভিন্ন গৃহস্থের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজে যায়। এখন কাজ করে দিনের পারিশ্রমিক পাচ্ছেন ৩৫০-৪০০ টাকা।”
মিরপুর পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিল জাহিদ হোসেন বলেন, “পৌর বাজারে শ্রমিকের হাট বসে প্রতিদিনই। গৃহস্থরা চাহিদামতো বাড়ি বা ক্ষেতের কাজ করানোর জন্য শ্রমিকদের নিয়ে যায়। এতে করে উভয়পক্ষ লাভবান হয়। তবে এখন চাল-ডাল সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও বাড়েনি তাদের পারিশ্রমিক। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।”