বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে টিকিট সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, নির্ধারিত কিছু ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগসাজশে এই সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে বিমানের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে গত ১৮ আগস্ট ঢাকা থেকে চীনের গুয়াংজু রুটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট চালু হওয়ার পর। ওই ফ্লাইটে “টেকঅফ ট্রাভেলস” এজেন্সির মাধ্যমে ১৭৭টি টিকিট বিক্রি হয়েছিল। যদিও ফ্লাইটি সম্পর্কে বলা হয়েছিল, এই ফ্লাইটের টিকিট কেবল বিমান বাংলাদেশের অফিশিয়াল কাউন্টারে পাওয়া যাবে।
বিমানের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ফ্লাইটির টিকিট বিক্রি শুরু হওয়া নির্ধারিত দিনের আগেই “টেকঅফ ট্রাভেলস”র কাছে প্রায় ৫০টি টিকিট বিক্রি করা হয়। ওই ফ্লাইটির অধিকাংশই ছিলেন চীনা নাগরিক।
আগস্টে যোগাযোগ করা হলে বিমানের নতুন সিইও ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাহিদ হোসেন ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, কোনো ট্রাভেল এজেন্সিকে প্রথম ফ্লাইটের টিকিট বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়নি। নিয়ম লঙ্ঘন করে টেকঅফ ট্রাভেলসের টিকিট বিক্রির বিষয়টি নিয়ে তিনি অবগত নন। সেই সঙ্গে টিকিট সমস্যার জন্য বিপণন বিভাগকে অবশ্যই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে বলেও জানান তিনি।
ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট বিক্রির কথা স্বীকার করলে বিমানের বিপণন ও বিক্রয় অধিদপ্তরের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন এটিকে কোনো সমস্যা বলে মনে করেন না।
তিনি বলেন, “এটা সবসময়ই হয়ে আসছে। শুধু টেকঅফ ট্রাভেলস নয়, আরও কিছু এজেন্সিও আমাদের হাতে নগদ টাকা দিয়ে বিমানের টিকিট বিক্রি করেছে। টিকিটে এজেন্সির নাম লেখা নেই, তাই কোন এজেন্সি আমাদের টিকিট বিক্রি করে তা আমরা বিবেচনা করি না। আমাদের কাজ হলো টিকিট বিক্রি করা এবং অর্থ উপার্জন করা।”
তবে ট্রাভেল এজেন্সির এক কর্মকর্তার অভিযোগ, বিপণন ও বিক্রয় অধিদপ্তরের মহাব্যবস্থাপককে পর্যাপ্ত কমিশন দিতে না পারায় তাদের টিকিট কিনতে দেওয়া হয়নি।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট বিক্রির অনুমতি দিলেও কোনো ফ্লাইটের সব টিকিট কখনোই কোনো একক ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে বিক্রি করা উচিত নয়।
বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, “একটি এজেন্সিকে বিমানের টিকিট বিক্রির অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিপণন ও বিক্রয় অধিদপ্তরের মহাব্যবস্থাপকসহ যেই জড়িত থাকুক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনার পর ১৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ঢাকা-গুয়াংজু ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে যাত্রা করে। বিমানের কাউন্টার থেকে ফ্লাইটের সব টিকিট বিক্রি করা হয়।
পরে ১২ সেপ্টেম্বর আবারও বিমান বাংলাদেশ নির্দেশনা দেয়, কেবল অফিসিয়াল কাউন্টার এবং কেন্দ্র থেকে টিকিট বিক্রি করার।
তবে, ঢাকা-গুয়াংজুর তৃতীয় ফ্লাইটের ৬০টি টিকিট বিক্রির জন্য বিমান ইতিমধ্যেই একজন জিএসএ এজেন্ট ব্যবহার করেছে। এটি ১৩ অক্টোবর যাত্রা শুরু করবে।
সাত কর্মকর্তার সিন্ডিকেট
বিমান এবং ট্রাভেল এজেন্সি সূত্র জানায়, ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কাছে টিকিট বিক্রি প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন বিমানের বিপণন ও বিক্রয় অধিদপ্তরের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, ব্যবস্থাপক (ই-কমার্স) আবু জাফর মোহাম্মদ শামসুল আলম, ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাপক (রাজস্ব) একেএম শহিদুল হাসান, মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়) দিলীপ কুমার, মহাব্যবস্থাপক (রাজস্ব) মোহাম্মদ মিজানুর রশীদ, উপ-মহাব্যবস্থাপক (মূল্য নির্ধারণ ও আরএমএস) মোহাম্মদ আলী ওসমান নূর এবং ব্যবস্থাপক কমার্শিয়াল আনায়েত হোসেন।
কর্মকর্তাদের মধ্যে আদান-প্রদান করা ইমেলগুলোতে মহাব্যবস্থাপক (বিপনন ও বিক্রয়) সালাহউদ্দিন অন্যদের টিকিট বিক্রয়ের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে বলেছেন।
“টেকঅফ ট্রাভেলস”র টিকিট বিক্রির অনুমোদন ওই কর্মকর্তাদের ইমেলের মাধ্যমে করা হয়েছিল। টেকঅফ ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপক আতাহারুল ইসলাম ১৪ আগস্ট ২০ জন যাত্রীর জন্য “বিশেষ ভাড়া” সুবিধা দেওয়ার আবেদন করেন। তার আবেদন আমলে নিয়ে জিএম সালাহউদ্দিন প্রতি টিকিটে ২০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ সাড়ে ৭৬ হাজার টাকা পর্যন্ত কমানোর অনুমোদন দেন।
প্রথম ফ্লাইটের আগের দিন ১৭ আগস্ট এই প্রতিবেদক যাত্রীর ছদ্মবেশে “টেকঅফ ট্রাভেলস”র সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রতিষ্ঠানটির আতাহারুল ইসলাম ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “ট্রাভেল এজেন্সি টিকিট বিক্রির অনুমতি পেয়েছে।”
এদিকে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বিমানের টিকিটের ব্যবসা কিছু অসাধু সিন্ডিকেট দখল করেছে। এতে বিমানের নিয়ম লঙ্ঘন করছে। কেলেঙ্কারিটি স্পষ্টতই একটি অভ্যন্তরীণ কাজ। বিমানের কিছু কর্মকর্তা অবৈধ আয়ের জন্য তাদের পদ-পদবীর অপব্যবহার করছে।”
তিনি আরও বলেন, “বিমানের শীর্ষ ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনা পর্ষদ, সেইসঙ্গে তাদের তদারকি কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থায় এই ধরনের নির্লজ্জ ও নিয়মতান্ত্রিক দুর্নীতির দায় এড়াতে পারে না। অভিযোগগুলো যথাযথভাবে তদন্ত করে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি।”