অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগে গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া পেয়ারা বাগান এলাকা থেকে সুতা ব্যবসায়ী রবিউলকে আটক করে বাসন থানা পুলিশ। তার সঙ্গে থাকা আরও তিনজনকে পরে ছেড়ে দিলেও মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত রবিউলকে ছাড়া হয়নি। ওইদিন দিবাগত রাত ২টার দিকে রবিউলের স্ত্রী নুপুর বেগমকে খবর দিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
থানায় গেলে পুলিশ তার কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নিয়ে জানায়, তার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। রাত ৩টার দিকে তিনি জানতে পারেন তার স্বামী ঢাকা মেডিকেলে মারা গেছেন।
অভিযোগ উঠেছে, থানায় পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে রবিউলের মৃত্যু হয়। এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ। যদিও এ ঘটনার পর বাসন থানার দুই সহকারী উপপরিদর্শককে (এএসআই) প্রত্যাহার করেছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
নিহতের মামাতো ভাই আব্দুল কালাম দাবি করেন, “স্বামীর জন্য পুলিশের কাছে সাদা কাগজে সই দিয়ে রবিউলের স্ত্রী নুপুরের আকুতি ছিল- আমার স্বামীকে একনজর দেখতে দেন। পুলিশ তা না করে উল্টো তার কাছ থেকে জোরপূর্বক সই নিতে উদগ্রীব হয়ে ছিল। রবিউল এলাকায় সবার কাছে সহজ-সরল মানুষ হিসেবে পরিচিত। তার নামে কোনো মামলা নেই। কারও সঙ্গে উঁচুস্বরে সে কখনও কথা বলেনি। সে সুতা, বোতাম, বক্রম ও পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত নানান উপকরণ বিক্রি করতো।”
১৫ বছর ধরে পেয়ারাবাগে রবিউল
রবিউল গাজীপুরের পেয়পারাবাগ এলাকার শাহানাজের গলিতে থাকতেন। সেখানে ৯০ ভাগ ভাড়াটিয়ার গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায়। তারা ওই এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবনযাপন করছেন।
নিহত রবিউল গত ১৫ বছর ধরে পেয়ারাবাগ এলাকায় সপরিবারে বসবাস করছেন। তার দুই মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে বয়স ১০ ও ছোট মেয়ের বয়স ৮।
পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিল পুলিশ
ভুক্তভোগী পরিবারটির প্রতিবেশী তারাজুল ইসলাম ও আব্দুল ছালাম দাবি করেন, “রবিউলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর একাধিকবার তার স্ত্রী পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তার স্ত্রী পেয়ারাবাগে তার স্বজনদের থানার পরিস্থিতি জানিয়েছেন। রবিউলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িতে উঠিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়।”
আরও পড়ুন- গাজীপুরে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগে স্বজনদের সড়ক অবরোধ
তারা আরও দাবি করেন, “রবিউলের স্ত্রী নুপুর আমাদের জানান, তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া দেলোয়ারসহ অপর দুজনের কাছ থেকে ৩০ হাজার করে টাকা নিয়ে ঘটনার দিনই ছেড়ে দেওয়া হয়। রবিউলের স্ত্রী যতবার থানায় গেছেন ততবারই তার কাছে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ চায় পুলিশ। ধরে নিয়ে যাওয়ার দিন ৮৫ হাজার টাকা পুলিশকে দিয়েছে পরিবারটি। রবিউলের মোবাইলে পাঁচ কোটি টাকার মতো লেনদেন হয়েছে দেখতে পেয়ে পুলিশ তাকে ছাড়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে।”
‘ধরে নিয়ে গিয়ে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় পুলিশ'
প্রতিবেশী আয়তাল দাবি করেন, “রবিউলকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নুপুরকে বাসন থানা পুলিশের লোকজন বাসা থেকে গাড়িতে করে নিয়ে যায়। গাড়িতে বসেই নুপুরের কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নেওয়া হয়। এ সময় নুপুর রবিউলকে দেখতে চাইলে রাতে বাসায় ফিরবে বলে সই দিতে জোর করে পুলিশের লোকজন। সই দিয়ে দিলে তাকে আর থানায় নেওয়া হয়নি, মাঝপথে থেকেই বাসায় দিয়ে যায়।”
তিনি আরও দাবি করেন, “রবিউল ১০ বছরের জন্য পেয়ারাবাগ এলাকায় জায়গা ভাড়া নিয়ে বাড়ি করে সেখানেই থাকতেন। তার বাড়িতে রুম ভাড়া দেওয়া আছে। কোনো ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেননি। কখনও জুয়া খেলাতো দূরের কথা ধূমপান পর্যন্ত করতেন না।”
রবিউলকে আদালতে না পাঠানোর বিষয়ে ওই এলাকায় বসবাসরতদের অভিযোগ, “ঢাকা-টাঙ্গাইল বাইপাস সড়কে ভ্যানগাড়িতে পণ্য বিক্রিসহ নানা কারণে প্রায়ই পুলিশ বিভিন্ন লোকজনকে ধরে নিয়ে আদালতে পাঠায়। যারা টাকা দিতে পারে তাদের থানা থেকেই ছেড়ে দেয়। কিন্তু রবিউলকে চার দিন পুলিশ কেন থানায় রাখলো? পুলিশ তাকে নির্যাতন করে মেরে বলছে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমরা এখন সব বলে দিচ্ছি। পুলিশ লোক ধরে নিয়ে যায় আর টাকার বিনিময়ে থানা থেকে ছেড়ে দেয়। গত তিন বছর ধরে পুলিশ এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমরা সত্য বলে দেওয়ার জন্য যদি মরতে হয় তবে মরবো। পুলিশ আমাদের এলাকায় কী করছে সব সত্য বলে দেবো।”
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অপরাধ বিভাগের উপ-কমিশনার (উত্তর) আবু তোরাব শামসুর রহমান বলেন, “টাকা নিয়ে আসামি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা আমি আপনাদের কাছ (সাংবাদিক) থেকে শুনলাম। তদন্ত করে দেখবো। এমন হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”