Saturday, March 22, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

গ্যাসের চুলা জ্বালানোর আগে ‘সাবধান’ হতে বললো তিতাস

বুধবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পাতায় সতর্কবার্তা দিয়ে একটি পোস্ট দেওয়া হয়

আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:০৫ পিএম

ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সোমবার (২৪ এপ্রিল) রাতে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে নগরবাসী। বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে চুলা বা অন্যান্য কাজে আগুন না জ্বালাতে প্রচারণা চালানো হয়।

এবার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ব্যবহারকারীদের জন্য “সতর্কবার্তা” দিলো। দুর্ঘটনা এড়াতে সকালে ঘরের দরজা, জানলা খুলে ১৫ মিনিট অপেক্ষার পর চুলা জ্বালানোর পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। যে কোনো প্রয়োজনে হটলাইনে (১৬৪৯৪) কল করতেও বলা হয়েছে।

বুধবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পাতায় এই সতর্কবার্তা দিয়ে একটি পোস্ট দেওয়া হয়।

এতে বলা হয়, “রান্না ঘরের চুলা জ্বালানোর পূর্বে দরজা জানালা খুলে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে রান্না করুন। যে কোনো প্রয়োজনে তিতাস হট লাইন ১৬৪৯৬ নম্বরে কল করুন -তিতাস কর্তৃপক্ষ।”

এর আগে তিতাস কর্তৃপক্ষ বলছিল, সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাসাবাড়ির সরবরাহ লাইনের ছিদ্র দিয়ে এই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাসের চাপ কমিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।

ঢাকার সরবরাহ লাইনের হালচাল

ঢাকার বাসাবাড়িতে তিতাসের গ্যাস সরবরাহের লাইনগুলো ৪০ বছরের পুরোনো। এক দশক আগে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া এসব লাইন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রায়ই গ্যাসের সরবরাহ লাইনে ছিদ্র (লিকেজ) পাওয়া যাচ্ছে। অবৈধ সংযোগের কারণেও পাইপলাইনে ছিদ্র তৈরি হয়েছে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড সূত্র জানায়, ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করে এই প্রতিষ্ঠান। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ সংস্থাও এটি।

ঢাকায় তাদের সাত হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। তিতাসের আওতাধীন এলাকায় মোট সংযোগ ২৮ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৪টি। এর মধ্যে আবাসিক সংযোগ আছে ২৮ লাখ ৫৭ হাজার ৯৩৬টি।

রাজধানী শহরে ১৯৬৭ সালে পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শুরু করে তিতাস। তবে এটি বেশি ছড়ায় ১৯৮০ সালের পর। সেসব পাইপলাইনের মেয়াদ ছিল ৩০ বছর। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ বছর পরও ওই পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই গ্যাস সরবরাহের লাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

পাইপলাইনে ছিদ্র, বড় ঝুঁকি

গ্যাসলাইনে ছিদ্রের কারণে দেড় বছর আগে নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে মারা যান ৩৪ জন।

২০২১ সালের জুনে মগবাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণের পর পুলিশের তদন্তে দেখা গেছে, তিতাসের বিচ্ছিন্ন করা পাইপলাইন সংযোগ থেকে গ্যাস জমে ওই দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

সম্প্রতি সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় ও সিদ্দিকবাজারে ভবনের বিস্ফোরণের ঘটনার পরও একই সন্দেহ করছে পুলিশ।

মগবাজার, সায়েন্স ল্যাব ও সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে মারা গেছেন ৩৯ জন।

সরবরাহ লাইনের ছিদ্র বোঝা যায় যেভাবে

পাইপলাইনে ছিদ্র রয়েছে কি না, তা একধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। এ জন্য পাইপলাইনের ওপর দিয়ে যন্ত্রটি চালিয়ে নেওয়া হয়।

উন্নত দেশগুলোতে গ্যাস পাইপলাইনে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ থাকে। এটিকে বলা হয়, সুপারভাইজরি কন্ট্রোল অ্যান্ড ডেটা অ্যাকুইজিশন সিস্টেম, যা স্ক্যাডা সিস্টেম নামেও পরিচিত। এতে গ্যাসলাইনের কোথাও ছিদ্র হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা যায়। অনেক দিন ধরে দেশে এই প্রযুক্তি আনার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত তা শুরু হয়নি।

গত অর্থবছরে ঢাকার ১ হাজার ৬৮২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মান কোন পর্যায়ে আছে, তা নিয়ে একটি জরিপ করে তিতাস।

এতে পাইপলাইনের ওপর ৯ হাজার ৯২৬ স্থানে গ্যাসের উৎস (মিথেন) শনাক্ত হয়। যার মধ্যে ৪৫৯টি ছিদ্র ধরা পড়ে। পরে সেগুলো সংস্কার করা হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুরো পাইপলাইন নিয়ে জরিপ করা হলে আরও অনেক ছিদ্র পাওয়া যাবে।

তিতাস কর্তৃপক্ষ বলছে, অবৈধ গ্যাস–সংযোগের কারণে সরবরাহ লাইনে ছিদ্র বেশি হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ প্রদানকারীরা লাইনের যত্রতত্র ছিদ্র করে। অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে তিতাস নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।

সংযোগ নিয়ে নয়ছয়

গ্যাস-সংকট বাড়তে থাকায় ২০১০ সালে আবাসিক সংযোগ দেওয়া বন্ধ করা হয়।

মাঝে তা কিছুটা শিথিল করা হলেও ২০১৫ সাল থেকে আবাসিক সংযোগ দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ আছে।

এ সুযোগে একটি চক্র বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ সংযোগ দিচ্ছে।

গত দুই বছরে ৩৪০ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাসলাইন উচ্ছেদ করেছে তিতাস। এরপরও থেমে নেই অবৈধ সংযোগ দেওয়া।

কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ বলেন, চাহিদার তুলনায় চাপ বেশি থাকায় লাইনের ছোটখাটো ছিদ্র দিয়ে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। খবর পাওয়া মাত্র তিতাসের ১৪টি দল ঘটনাস্থলে যায়। গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণে এনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়েছে। বড় কোনো ছিদ্র পাওয়া যায়নি। সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে ও নির্ভয়ে রান্নাবান্না করতে পারেন।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের অর্থ এই নয় যে আশঙ্কামুক্ত। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত যে শহরবাসী প্রতিনিয়ত গ্যাসের ঝুঁকির মধ্যেই আছে। বিতরণ লাইনগুলো নিয়ম মেনে সময়ে-সময়ে তদারকি করার কথা থাকলেও তিতাস তা করছে না। ভোক্তাদের জীবন তিতাসের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, তিতাসের সঞ্চালন লাইনে যে ত্রুটি আছে, এ ঘটনায় তা আবার নতুন করে প্রমাণিত হলো। আবাসিক এলাকাগুলো ভয়ানক ঝুঁকিতে আছে। গতকাল বিভিন্ন জায়গায় গ্যাস বের হয়ে গেছে। এই গ্যাস কোথাও জমা থাকলে আবারও সমস্যা হতে পারে। তাই এটা বলা যাবে না যে ঝুঁকি শেষ হয়েছে। তিতাসের সঞ্চালন লাইনগুলো মেরামত শুধু নয়, নতুন লাইন বসাতে হবে।

গ্যাসের পাইপলাইনে ছিদ্র বা গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনায় নগরবাসীর করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়াসির আরাফাত বলেন, বাসাবাড়িতে গ্যাস জমা না থাকলে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা কম। দরজা-জানালা খোলা রেখে তারপর চুলা জ্বালাতে হবে। রান্নাঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখলে গ্যাস ছড়ালেও তা সরে যেতে পারে। অর্থাৎ সেখানে ঝুঁকি কম থাকে।

   

About

Popular Links

x