স্কুল-কলেজ খোলার পর থেকেই মহামারিকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার এ ক্ষত অনেকটাই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে
প্রতীকী ছবি। রয়টার্স
দুলাল আব্দুল্লাহ, রাজশাহী
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২১, ১০:১১ এএমআপডেট : ০৭ মার্চ ২০২২, ০৪:৫৮ পিএম
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর খুলেছে স্কুল-কলেজ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রাজশাহীতে হাজারও শিক্ষার্থীর জীবনে।
স্কুল-কলেজ খোলার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষত অনেকটাই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। তাসের ঘরের মতোই ভেঙেছে হাজারও স্বপ্ন। জেলাটিতে ১৮ মাসে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি মেয়ে শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ে শিকার হয়েছে। এরসঙ্গে বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংতার ঘটনাও।
রাজশাহী জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, রাজশাহীতে ষষ্ঠ থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ১২ হাজার ১৬৩ জন। এরমধ্যে মোট মেয়ে শিক্ষার্থী ১ লাখ ৩ হাজার ৪০৭ জন। এদের মধ্যে প্রায় ৬,৫১২ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন। রাজশাহীতে বাল্যবিয়ের হার প্রায় ৬.২৯% এর বেশি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাঘা উপজেলায় ৩,৪৫৭ জন ছাত্রীর মধ্যে ১২১ জনের বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৩.৫৭%। বাগমারা উপজেলায় ২১,৩৯০ জন
শিক্ষার্থীর মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১,৭৮৫ জন। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি ৮.৩৪%। চারঘাট উপজেলায় ৯,০৩১ জনের মধ্যে ৬৮৪ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭.৫৭%। দুর্গাপুর উপজেলায় ৬,৬০২ জন ছাত্রীর মধ্যে ৪৯০ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭.৪২%।
গোদাগাড়ী উপজেলায় ১২,৯৯২ জন ছাত্রীর মধ্যে ৮৭৩ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৬.৭১%। মোহনপুর উপজেলায় ৬,৫৬০ জন ছাত্রীর মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৫০১ জন। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭.৬৯%। পবা উপজেলায় ১১,২৯৬ জনের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৮৩০ জন। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭.৩৫%। পুঠিয়ায় ৭.৫৮৭ জনের মধ্যে ৪৬৫ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৬.১২%। তানোরে ৮,৪৪২ জনের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৬৮০ জন। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৮.৫%।
রাজশাহীর উপজেলাগুলোর তুলনায় নগরীতে বাল্যবিয়ের হার অনেকটাই কম। নগরীর বোয়ালিয়া থানায় ৭,২৫০ জনের মধ্যে ১৯ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই থানায় বাল্যবিয়ের হার ০.২৬%। মতিহার থানায় ৮,৮০০ জনের মধ্যে ৬৪ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। এই থানায় বাল্যবিয়ের হার ০.৭৩%।
রাজশাহীর দুর্গাপুর পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ রাখছি, শিক্ষার্থীদের স্কুলের উপস্থিত হওয়ার জন্য বলছি। এমনকি পাশাপাশি অভিভাবকদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে। এতে অল্পসময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেড়ে যাবে এবং শিক্ষার পরিবেশ ফিরে পাবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
দুর্গাপুর উপজেলার আমগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তসলিম আলী বলেন, “সার্কের নির্দেশনা মেনে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে যাচ্ছি। নিয়মিত শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এমনকি শিক্ষার্থীদের স্কুলে উপস্থিত হওয়ার জন্য বিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে।”
বাঘা উপজেলার পলাশি ফতেপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান বলেন, “সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরেও গোপনে বাল্যবিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না। ছুটির মধ্যে আমার স্কুলের ১২ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে।”
বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল আযম বলেন, “এমনিতে পদ্মার চরের মানুষ দরিদ্র। ছেলে-মেয়েরা একটু বড় হয়ে গেলে মনে করেন পরিবারে একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাল্যবিয়ের প্রবণতা চর এলাকায় অনেক বেশি। তারপরেও অনেক চেষ্টা করা হয়, সচেতন করা হয়, যেন বাল্যবিয়ে না দেওয়া হয়। বাল্যবিয়ের বিষয়ে জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনকে জানিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছুটির সময় কয়েকটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
এ বিষয়ে বাঘা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কাশেম মোহাম্মদ ওবাইদ বলেন, “বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপরেও যদি কোনো বাবা-মা গোপনে তাদের ছেলেমেয়ের বিয়ে দেন, সেক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। তবে এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সদস্য ড. একেএম মাহমুদুল হক বলেন, “বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক নতুন করে তুলে ধরার কিছু নেই। রাজশাহীতে করোনাভাইরাসও এতজনের প্রাণও কেড়ে নিতে পারেনি যতজনের শৈশব-কৈশোর, স্বপ্ন, সুযোগ ও সম্ভাবনা কেড়ে নিয়েছে বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ের শিকার এই মেয়েদের বেশির ভাগই হয়ত তাদের কৈশোরকে উপভোগ করতে পারবে না। পারবে না নিজের সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করতে। বাল্যবিয়ের এই ক্ষতিকর দিকের প্রভাব যে শুধু তাদের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকবে তাও না। তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরও এই প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এর ক্ষতিকর প্রভাব থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, “বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে দরিদ্রতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বড় দুইটি কারণ। এক্ষেত্রে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের প্রতিটা ইউনিয়ন, উপজেলায় যে বাল্যবিবাহ রোধ কমিটি আছে তাদের নিষ্কিয়তা দূর করতে হবে। সর্বোপরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাল্যবিয়ে রোধে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।”
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচি (বিএলসি) রাজশাহী জোনাল ম্যানেজার সুফিয়া খাতুন জানান, সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাল্যবিয়ে রোধসহ নারী ও শিশুর মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন। ব্র্যাক বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কোভিডকালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। গত দুইবছরে তাদের কাছে প্রায় দুই হাজার অভিযোগ এসেছে। এসব ঘটনার অধিকাংশই সামাজিকভাবে মীমাংসা করা হচ্ছে। আবার অনেকেই বিচারহীনতায় ভুগছেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকতা শবনম শিরিন বলেন, “কোভিড মহামারিকালে বাল্যবিয়ে ও নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে এটা সত্য। এর পেছনে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বাস্তবতা রয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এবিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, “বাল্যবিবাহ রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরও কাজ করছে। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকেই মূখ্য ভূমিকা রাখতে হবে। তারা আগে বাল্যবিয়ের খবর পেলে সেখানে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছেন।”
মহামারির ১৮ মাসে রাজশাহীতে সাড়ে ৬ হাজার বাল্যবিয়ে
স্কুল-কলেজ খোলার পর থেকেই মহামারিকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার এ ক্ষত অনেকটাই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর খুলেছে স্কুল-কলেজ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রাজশাহীতে হাজারও শিক্ষার্থীর জীবনে।
স্কুল-কলেজ খোলার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষত অনেকটাই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। তাসের ঘরের মতোই ভেঙেছে হাজারও স্বপ্ন। জেলাটিতে ১৮ মাসে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি মেয়ে শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ে শিকার হয়েছে। এরসঙ্গে বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংতার ঘটনাও।
রাজশাহী জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, রাজশাহীতে ষষ্ঠ থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ১২ হাজার ১৬৩ জন। এরমধ্যে মোট মেয়ে শিক্ষার্থী ১ লাখ ৩ হাজার ৪০৭ জন। এদের মধ্যে প্রায় ৬,৫১২ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন। রাজশাহীতে বাল্যবিয়ের হার প্রায় ৬.২৯% এর বেশি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাঘা উপজেলায় ৩,৪৫৭ জন ছাত্রীর মধ্যে ১২১ জনের বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৩.৫৭%। বাগমারা উপজেলায় ২১,৩৯০ জন
শিক্ষার্থীর মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১,৭৮৫ জন। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি ৮.৩৪%। চারঘাট উপজেলায় ৯,০৩১ জনের মধ্যে ৬৮৪ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭.৫৭%। দুর্গাপুর উপজেলায় ৬,৬০২ জন ছাত্রীর মধ্যে ৪৯০ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭.৪২%।
গোদাগাড়ী উপজেলায় ১২,৯৯২ জন ছাত্রীর মধ্যে ৮৭৩ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৬.৭১%। মোহনপুর উপজেলায় ৬,৫৬০ জন ছাত্রীর মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৫০১ জন। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭.৬৯%। পবা উপজেলায় ১১,২৯৬ জনের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৮৩০ জন। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭.৩৫%। পুঠিয়ায় ৭.৫৮৭ জনের মধ্যে ৪৬৫ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৬.১২%। তানোরে ৮,৪৪২ জনের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৬৮০ জন। এই উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৮.৫%।
রাজশাহীর উপজেলাগুলোর তুলনায় নগরীতে বাল্যবিয়ের হার অনেকটাই কম। নগরীর বোয়ালিয়া থানায় ৭,২৫০ জনের মধ্যে ১৯ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই থানায় বাল্যবিয়ের হার ০.২৬%। মতিহার থানায় ৮,৮০০ জনের মধ্যে ৬৪ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। এই থানায় বাল্যবিয়ের হার ০.৭৩%।
রাজশাহীর দুর্গাপুর পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ রাখছি, শিক্ষার্থীদের স্কুলের উপস্থিত হওয়ার জন্য বলছি। এমনকি পাশাপাশি অভিভাবকদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে। এতে অল্পসময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেড়ে যাবে এবং শিক্ষার পরিবেশ ফিরে পাবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
দুর্গাপুর উপজেলার আমগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তসলিম আলী বলেন, “সার্কের নির্দেশনা মেনে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে যাচ্ছি। নিয়মিত শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এমনকি শিক্ষার্থীদের স্কুলে উপস্থিত হওয়ার জন্য বিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে।”
বাঘা উপজেলার পলাশি ফতেপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান বলেন, “সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরেও গোপনে বাল্যবিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না। ছুটির মধ্যে আমার স্কুলের ১২ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে।”
বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল আযম বলেন, “এমনিতে পদ্মার চরের মানুষ দরিদ্র। ছেলে-মেয়েরা একটু বড় হয়ে গেলে মনে করেন পরিবারে একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাল্যবিয়ের প্রবণতা চর এলাকায় অনেক বেশি। তারপরেও অনেক চেষ্টা করা হয়, সচেতন করা হয়, যেন বাল্যবিয়ে না দেওয়া হয়। বাল্যবিয়ের বিষয়ে জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনকে জানিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছুটির সময় কয়েকটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
এ বিষয়ে বাঘা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কাশেম মোহাম্মদ ওবাইদ বলেন, “বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপরেও যদি কোনো বাবা-মা গোপনে তাদের ছেলেমেয়ের বিয়ে দেন, সেক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। তবে এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সদস্য ড. একেএম মাহমুদুল হক বলেন, “বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক নতুন করে তুলে ধরার কিছু নেই। রাজশাহীতে করোনাভাইরাসও এতজনের প্রাণও কেড়ে নিতে পারেনি যতজনের শৈশব-কৈশোর, স্বপ্ন, সুযোগ ও সম্ভাবনা কেড়ে নিয়েছে বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ের শিকার এই মেয়েদের বেশির ভাগই হয়ত তাদের কৈশোরকে উপভোগ করতে পারবে না। পারবে না নিজের সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করতে। বাল্যবিয়ের এই ক্ষতিকর দিকের প্রভাব যে শুধু তাদের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকবে তাও না। তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরও এই প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এর ক্ষতিকর প্রভাব থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, “বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে দরিদ্রতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বড় দুইটি কারণ। এক্ষেত্রে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের প্রতিটা ইউনিয়ন, উপজেলায় যে বাল্যবিবাহ রোধ কমিটি আছে তাদের নিষ্কিয়তা দূর করতে হবে। সর্বোপরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাল্যবিয়ে রোধে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।”
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচি (বিএলসি) রাজশাহী জোনাল ম্যানেজার সুফিয়া খাতুন জানান, সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাল্যবিয়ে রোধসহ নারী ও শিশুর মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন। ব্র্যাক বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কোভিডকালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। গত দুইবছরে তাদের কাছে প্রায় দুই হাজার অভিযোগ এসেছে। এসব ঘটনার অধিকাংশই সামাজিকভাবে মীমাংসা করা হচ্ছে। আবার অনেকেই বিচারহীনতায় ভুগছেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকতা শবনম শিরিন বলেন, “কোভিড মহামারিকালে বাল্যবিয়ে ও নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে এটা সত্য। এর পেছনে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বাস্তবতা রয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এবিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, “বাল্যবিবাহ রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরও কাজ করছে। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকেই মূখ্য ভূমিকা রাখতে হবে। তারা আগে বাল্যবিয়ের খবর পেলে সেখানে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছেন।”
বিষয়: