ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম পরিবর্তন, সংস্কার ও আধুনিকীকরণ করার কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
সোমবার (৭ আগস্ট) সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পরে আইনমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আধুনিকীকরণের পাশাপাশি এর অপব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একইসঙ্গে এই আইনের সংস্কার করে এর নাম বদলে “সাইবার নিরাপত্তা আইন” করতে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, “আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের সংস্কার করছি। মূলত শাস্তির পরিমাণ কমিয়েছি, অর্থাৎ মানহানির ক্ষেত্রে ফৌজদারি শাস্তির বিধান রদ করেছি। এটাই মূল বিষয়।”
নতুন “সাইবার নিরাপত্তা আইনে” কি কি থাকবে তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা। প্রতিবেদনটির আলোকে নিচে নতুন আইনের পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংস্কারগুলো তুলে ধরা হলো-
বিতর্কিত ধারা ৪৩ অপরিবর্তিত
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সেটি অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে।
এই ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, কোনো স্থানে এই আইনের অধীনে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; এই অপরাধের সাক্ষ্য প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা বা পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে কোন পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, সরঞ্জাম জব্দ ও গ্রেপ্তারের এখতিয়ার রয়েছে।
এটি অপরিবর্তিত রাখার যুক্তি হিসেবে আইনমন্ত্রী বলেন, “সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয় সেগুলো জব্দ না করলে প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেকারণে এটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।”
কিছু অপরাধ জামিনযোগ্য হচ্ছে
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮, ২৯ ও ৩০ ধারাগুলো বাতিলের বিষয়ে নানা সময়ে আহ্বান জানানো হয়েছে। এই ধারাগুলো বাতিল করা না হলেও সেগুলোতে সংশোধন আনা হয়েছে বলে জানান আইনমন্ত্রী।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করা বা উসকানি দেওয়ার জন্য ওয়েবসাইট বা অন্যকোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করে, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে তা অপরাধ হবে। এই অপরাধের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা দশ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। একই অপরাধ বারবার করলে সাজা ও জরিমানার মেয়াদ দ্বিগুণ হওয়ার বিধান ছিল।
আইনমন্ত্রী জানান, এই ধারায় সাজা কমানো হয়েছে। এটা আগে ছিল অ-জামিনযোগ্য। এটা জামিনযোগ্য করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এছাড়া একই অপরাধ বারবার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল।
এই ধারায় পরিবর্তন এনে কারাদণ্ডের যে সাজা ছিল সেটাকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। এখানে শাস্তি হবে শুধু জরিমানা (২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত)। আর জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড হতে পারে।
আইনমন্ত্রী বলেন, “দেওয়ানি আইনে কেউ মানহানির জন্য মামলা করলে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার কোনো সীমা নাই। তিনি চাইলে ১০০ কোটি টাকাও ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন। তবে সেটা কমিয়ে সর্বোচ্চ আদায় যোগ্য জরিমানার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। তবে কত টাকা জরিমানা করা হবে তা নির্ধারণ করবেন আদালত।”
মানহানির মামলায় কারাদণ্ডের বিধান না থাকায় এই ধারায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলে জানান আইনমন্ত্রী।
কিছু ধারায় শাস্তি কমানো হয়েছে
সাইবার নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ২১ ধারা।
এই ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে দেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালায় বা তাতে মদদ দেয় তাহলে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হতো। এর জন্য ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল।
এই একই অপরাধ কেউ দ্বিতীয়বার করলে তার সাজা দ্বিগুণ করার বিধান ছিল। আর বারবার একই অপরাধের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল।
এই ধারাটিতে পরিবর্তন এনে সাজার মেয়াদ ৭ বছর করা হচ্ছে নতুন আইনে। আর দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলেও সাজা দ্বিগুণ হবে না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছিল, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৭ বছর এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। একাধিক বার একই অপরাধ করলে সাজা বেড়ে ১০ বছর এবং জরিমানা ১০ লাখ টাকা করার বিধান ছিল।
এই ধারায় পরির্বতন এনে সাজার সময়-সীমা কমানো হয়েছে। সাত বছরের কারাদণ্ডের পরিবর্তে পাঁচ বছর করা হয়েছে। বারবার একই অপরাধ করলে সাজা বাড়ানোর বিষয়টি বাতিল করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের শাস্তি ছিল ১৪ বছর, সেটি কমিয়ে ৭ বছর করা হয়েছে। বারবার এই অপরাধ করলে সাজা বাড়ার বিধান বাতিল করা হয়েছে।
হ্যাকিং সম্পর্কিত ধারা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩৩ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ নামে নতুন ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
হ্যাকিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার তথ্য ভাণ্ডারের কোনো তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তন বা তার মূল্য বা উপযোগিতা কমানো বা অন্যকোনোন ভাবে ক্ষতিসাধন বা নিজ মালিকানা বা দখল বিহীন কোনো কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা অন্যকোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে তার ক্ষতিসাধন হবে হ্যাকিং।