আলফ্রেড সরেন হত্যার ২৩ বছর: খুনিরা জামিনে, বিচার নিয়ে শঙ্কানওগাঁয় আদিবাসীদের ভূমি-অধিকার আন্দোলনের নেতা আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার শেষ হয়নি ২৩ বছরেও। আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত ওই ঘটনার করা মামলার আসামিরা জামিনে রয়েছেন। এ ঘটনায় বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার পরিবার, আদিবাসী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।
যা ঘটেছিল সেদিন
আলফ্রেড সরেনের পরিবার জানায়, ২০০২ সালের ১৮ আগস্ট দিকে ভূমিদস্যুদের একটি চক্র মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর গ্রামের আদিবাসী পল্লীতে হামলা চালিয়ে সেখানকার ১১টি বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে নারী ও শিশুসহ ৩০ জন আহত হন। এমনকি কয়েকজন শিশুকে পুকুরে নিক্ষেপ করে তারা।
এ ঘটনার প্রতিবাদে সেদিন বেলা ১২টার দিকে নওগাঁ-মহাদেবপুর সড়কের চৌমাসিয়ার মোড়ে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয় আদিবাসীরা। সবাই জড়ো হয় সেখানে। এরমধ্যেই আলফ্রেড নিজের বাড়ি যান। এলাকাটি সেসময় ছিল মানবশূন্য। তিনি বাড়ি যেতেই সন্ত্রাসীরা হামলা করতে উদ্যত হয়। বুঝতে পেরে তিনি নিজের ঘর ছেড়ে অন্য বাড়ি আশ্রয় নেন। সন্ত্রাসীরা সেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে তিনি বেরিয়ে আসেন। আর তখনই ঘাতকরা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
তার পরিবার আরও জানায়, হামলার আগেই তিনি এমনটি হতে পারে বলে আঁচ করেছিলেন। সেদিন তার বোন ও মেয়ে দূরে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকায় বেঁচে যান। তবে তার স্ত্রী জোছনার চোখ জখম হয়।
সেদিনের সভায় বক্তব্য দিতে চৌমাসিয়ার মোড়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নওগাঁ জেলা কমিটির তৎকালীন সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়নুল হক মুকুল। তিনি বলেন, বেলা ১২টার দিকে গ্রামের দিকে তাকিয়ে দেখি আগুনের কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোয়া উড়ছে। সবাইকে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করি। কয়েকজন আদিবাসী এরমধ্যেই গ্রামের দিকে দৌড় দেন। আমরাও সেখানেই যাই। তবে ততক্ষণে সব শেষ।
ওই সহিংসতার জেরে এলাকাটিতে সে সময় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। তবে পরে সেটি উঠিয়ে নেওয়া হয়।
বিচারের অপেক্ষা
হত্যাকাণ্ডের পরে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা করেন আলফ্রেড সরেনের ছোট বোন রেবেকা সরেন। পুলিশ ৯১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতিবেদন দেন। গ্রেপ্তারও করা হয় কয়েকজনকে।
নওগাঁ দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলে ৪১ জন সাক্ষীর ১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়।
তবে যত সরকার ক্ষমতায় এসে জননিরাপত্তা আইন বাতিল করে। এরপর পলাতক শীতেষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই (বর্তমানে প্রয়াত) ও হাতেম আলীসহ ৬০ জনের বেশি আসামি জননিরাপত্তা আইনে করা মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে হাইকোর্ট মামলাটি তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। এরপরই আসামিরা জামিনে মুক্তি পান।
মামলাটির বাদী পক্ষের আইনজীবী ও নওগাঁ জেলা সিপিবির বর্তমান সভাপতি মহসীন রেজা বলেন, ওই ঘটনার একদিন আগে আলফ্রেড মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান আমজাদ হোসেন তারাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে তাকে হত্যা করা হতে পারে এমন শঙ্কা জানিয়ে সম্ভাব্য ১০ ঘাতকের নামও জানিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, হত্যা মামলাটি পুনরায় শুনানির জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনে পাঠানো হয়েছে।
কেমন আছে সরেনের পরিবার ও পল্লীর বাসিন্দারা
সম্প্রতি ভীমপুরের ওই আদিবাসী পল্লীতে গিয়ে এক নিস্তব্ধ পল্লীর দেখা মেলে। প্রাণচাঞ্চল্যহীন পল্লীতে এখনও বাস করছে ১২টি পরিবার। আলফ্রেড সরেনের মৃত্যুর এক বছর পরেই মা ঠাকুরানী সরেন ছেলের শোকে মারা যান। স্ত্রী বর্তমানে থাকেন তানোরে। আর মেয়ে ঝর্ণা সরেনের বিয়ে হয়েছে। হুমকি-আতঙ্ক নিয়েও পল্লীতে বাস করছেন তার ভাই মহেশ্বর সরেন ও বোন রেবেকা সরেন।
পল্লীর পাশেই এক বাঁশ ঝাড়ের ছায়ায় অযত্নের স্পষ্ট ছাপ থাকা আলফ্রেড সরেনের সমাধির দেখা মেলে। মাঝে মাঝে দেখভাল করেন পরিবারের সদস্যরাই।
এতো বছর পরেও বিচার না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ তার পরিবারের সদস্যরা। তাদের দাবি, আদিবাসীদের জন্য লড়াই করা নেতার হত্যাকারীদের বিচারের।
আইনজীবী মহসীন রেজা বলেন, ওই এলাকায় প্রচুর খাস জমি রয়েছে। যেখানে আদিবাসী ও ভূমিহীনদের দখলে রয়েছে মাত্র ৩০ বিঘার মত। ফলে ভূমিহীন ও আদিবাসীদের দখল হওয়া জমি তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পুনর্বাসন করতে হবে।