পার্বত্য জেলা বান্দরবানে গত সপ্তাহের ভয়াবহ বন্যায় যোগাযোগ, কৃষি, শিক্ষা, পর্যটন ও মৎস্য খাতে ৭০০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এই বন্যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যা। এদিক থেকে বন্যার ভয়াবহতা, সাত উপজেলার সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হিসেব করলে টাকার অংক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ১৯৯৭ সালের ২৫ বছর পর এবারের বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় প্রাণহানি হয়েছে ১০ জনের; আহত হয়েছেন শতাধিক। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৬ হাজার ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। এছাড়া ১৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ব্যবস্থায় ক্ষতি শত কোটি টাকা
বন্যায় জেলার ইন্টারনেট ব্যবস্থায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। থানচি ও রুমা উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ভেঙে পড়ে। এতে এই সেবা খাতটি শত কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
বান্দরবান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ আমির হোসেন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “বন্যায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন অচল হয়েছে, বৈদ্যুতিক পিলার ভেঙে পড়েছে, সাব-স্টেশন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে। জেলায় এই খাতটিতে মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় শত কোটি টাকা।”
কৃষিতে ক্ষতি ৩১১ কোটি টাকা
জেলায় এবারের বন্যায় ৮ হাজার ৮৫৩ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৭১ হাজার কৃষক।
জেলা কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক (শস্য) হাসান আলী জানান, বন্যায় কৃষিতে ৩১০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে রয়েছে আমন ও রোপা ধানের বীজতলা, কলা, পেঁপে, কাজু বাদাম, জুম চাষ ও সবজি।”
সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতি
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর জেলার সাথে থানচি ও রুমা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ এখনো বন্ধ রয়েছে। এই দুই উপজেলার সঙ্গে একমাত্র নৌপথে যোগাযোগ চালু রয়েছে। সড়ক মেরামত করে চালু করতে আরও এক মাস সময় লেগে যেতে পারে বলে জানা গেছে।
বান্দরবানের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জিয়াউল ইসলাম মজুমদার জানান, জেলার ৯০০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৩০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়কগুলো সংস্কার করতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন জানান, জেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ১৮১ কিলোমিটার সড়কপথ রয়েছে; এরমধ্যে ৫০ কিলোমিটার সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা।
বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া সড়কের স্থানগুলো উঁচুকরণ, ২১টি ব্রিজ, ১৫টি কালভার্ট, ২১ কিলোমিটার ড্রেনেজ নিষ্কাশন অবকাঠামোসহ বান্দরবান-কেরানিহাট মহাসড়কের ২৩ কিলোমিটার ক্ষতির মুখে পড়েছে। সম্প্রতি বান্দরবান-কেরানিহাট মহাসড়কটি ২৬৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়।
মৎস্য বিভাগের ক্ষয়ক্ষতি
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অভিজিত শীল জানান, মৎস্য বিভাগের ৪৩০টি জলাশয় ও বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা ১৬০টি প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি টাকা। তিনি বলেন, “১৫০টি জলাশয় ও ৩০টি লেক ভেসে গেছে লামা উপজেলায়।”
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষতি
এবারের বন্যায় বান্দরবানের ১৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। এছাড়া জেলা গণগ্রন্থাগারের ২৮ হাজার বই ও অফিসের যাবতীয় নথিপত্র নষ্ট হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যানুযায়ী, জেলার ১২৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ডুবে যাওয়ায় ১ কোটি ৩৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
পর্যটন খাতে ক্ষতি
বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার প্রধান সড়ক ধসে যাওয়ায় হোটেল-মোটেলগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যটনশিল্প।
জেলা হোটেল-মোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির অর্থ-সম্পাদক রাজীব বড়ুয়া জানান, বন্যায় হোটেল-মোটেল ডুবে গেছে; পর্যটন এলাকায় যাতায়াতের সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা সদর, রুমা ও থানচির পর্যটনকেন্দ্রগুলো ও হোটেল রিসোর্টগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। পর্যটকবাহী পাঁচ শতাধিক গাড়ি, হোটেল-মোটেল শ্রমিক, পর্যটক গাইডরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।