দেশের পোশাক খাতের ভয়ঙ্কর স্মৃতির নাম তাজরীনের অগ্নিকাণ্ড। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার সাভার উপজেলার নিশ্চিন্তপুর এলাকার কারখানাটিতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন অন্তত ১১৩ জন শ্রমিক। সেই ঘটনার ১১ বছর পূর্তি আজ।
সেদিনের আগুনের লেলিহান শিখা আজও ভয়াবহ হয়ে চোখে ফেরে ভুক্তভোগী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কাছে। আহত শ্রমিকরা অনেকে সাময়িক সহযোগিতা পেলেও পূর্ণাঙ্গ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন সুবিধা পাননি। ফলে অনেকে বেঁচে থেকেও ভুগছেন মৃত্যু যন্ত্রণায়। পোড়া শরীর, পঙ্গু দেহ নিয়ে জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। জীবিকা নির্বাহে অনেকেই শুরু করেছেন নতুন পেশা।
এমনই একজন সবিতা রানি। তাজরিনের সুইং অপারেটর ছিলেন। ভালো বেতন পেতেন। ঘটনার দিন তৃতীয় তলায় ছিলেন তিনি। সন্ধায় হঠাৎ বেজে ওঠা কারখানার ফায়ার অ্যালার্মে ভয় পেয়ে যান তিনি। একসময় আগুনের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে পুরো ফ্লোরে। এরপর অনেকের সঙ্গে তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়েন তিনি। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে শুরু হয় তার অনিশ্চিত জীবনের পথচলা।
সবিতা জানান, দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে পেটের দায়ে কাজে ফিরেছেন তিনি। তবে কারখানায় কাজ করার মতো শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। একসময় কারখানায় ঘুরেও কাজ না পেয়ে আহত শ্রমিকদের কয়েকজনকে নিয়ে নিজেই কারখানা শুরু করেছিলেন, তবে পুঁজির অভাবে তা আর চালানো সম্ভব হয়নি।
সবিতা বলেন, “এরপর অনেক কষ্টে একটা সেলাই মেশিন কিনে বাসায় টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করছি। পাশাপাশি একটি সংস্থার প্রচারণার জন্য বিভিন্ন জায়গায় লিফলেট বিতরণ করে দিন ৪’শ টাকা মজুরি পাই।”
তিনি আরও বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার পর সরকার যে সাহায্য করেছে তা চিকিৎসার পেছনেই শেষ হয়ে গেছে। আমরা সাহায্য চাই না, ক্ষতিপূরণ চাই। আমরা যাতে ভালোভাবে, সুস্থভাবে চলতে পারি সরকার ও বিজিএমইএ যেন এ ধরনের ব্যবস্থা করে।’’
একই ফ্লোর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাজরীনের অপারেটর শিল্পী বেগম। চিকিৎসার জন্যে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় সরকারি সাহায্যের তালিকায় নামটিও ওঠেনি তার। তাই বাধ্য হয়ে আবার ফিরে আসেন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে। এখানেই ভাড়া বাসায় ছোট মেয়ে ও মানসিক ভারসাম্যহীন বোনকে নিয়ে থাকেন তিনি।
বলেন, “ঘটনার দিন তিন তলা থেকে লাফিয়ে পড়েছিলাম। এরপর দেশের বাড়িতে চলে যাওয়ায় সরকারি সাহায্যের তালিকায় নাম ওঠেনি। এ কারণে কোনো প্রকার অনুদান পাইনি। তবে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাজরীনের শ্রমিক হিসেবে কিছুটা চিকিৎসা সেবা পেয়েছি। তারপরও কোনো সরকারি তালিকায় নাম নেই।”
শিল্পী আরও বলেন, “তাজরীনের ঘটনার পর শত চেষ্টা করেও কোনো কারখানায় চাকরি নিতে পারিনি। অন্য কারখানায় তাজরীনের শ্রমিকের কথা শুনলেই তাড়িয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে কখনও পিঠা বিক্রি করি, আবার কখনও টেইলার্সের কাজ করে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন পার করছি।”
“পরিত্যক্ত এই কারখানাটি সরকার খুলে দিলে সেখানে চাকরি করতে পারতাম। আমার মতো আহত শ্রমিকরা সেখানে কাজ করতে পারত। এজন্য সরকার ও বিজিএমইএ’র সুদৃষ্টি চাই।”
বিচার শেষ হয়নি
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বরের ওই ঘটনার পরেরদিন আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারা যুক্ত করা হয়।
সে বছরই ২২ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পরিদর্শক এ কে এম মহসিনুজ্জামান খান তাজরীনের চেয়ারম্যান ও এমডিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন।
কারখানা ভবনটির আইন মেনে নির্মাণ করা হয়নি। শ্রমিকদের বের হওয়ার জন্য ভবনটিতে জরুরি বহির্গমন পথ ছিল না। তিনটি সিঁড়ির মধ্যে দুটি নিচতলার গুদামের ভেতরে এসে শেষ হয়। ওই গুদামে আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বের হতে চাইলে কারাখানা ম্যানেজার শ্রমিকদের বাধা দিয়ে বলেন, আগুন লাগেনি। অগ্নিনির্বাপণের মহড়া চলছে। তিনি বের হওয়ার পথ বন্ধ করে দেন। ফলে শ্রমিকেরা নিচে নামতে পারেননি। মালিকের অবহেলাজনিত হত্যা ও নরহত্যার স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে বলে উল্লেখ করে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩২৩, ৩২৫, ৪৩৬, ৩০৪, ৩০৪-ক ও ৪২৭ ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগপত্রের বাকি আসামিরা হলেন, তাজরীন ফ্যাশনসের এমডি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আকতার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনারুল, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ আল-আমিন ও লোডার শামীম মিয়া।
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র ১১ জন।
আলোচিত এ মামলাটি বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। সবশেষ গত ১ নভেম্বর মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ দিন ধার্য ছিল। ওই দিনও সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় আদালত পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২৫ মার্চ দিন ধার্য করেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, “তাজরীন ট্র্যাজেডির ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা সামান্য সাহায্য ব্যতীত প্রকৃত পুনর্বাসন সুবিধা পায়নি। আর দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন থাকার কারণেই তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে পারিবারিকভাবেও তারা অশান্তিতে রয়েছে। এছাড়া মানসিক সমস্যার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া। বরং দায়ী ব্যক্তিকে ক্ষমতাসীন দলে পদায়ন করে পুরষ্কৃত করা হয়েছে।”
তাই তাজরীনের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের প্রকৃত পুনর্বাসন নিশ্চিত করা গেলে তাদের এই মানুষিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা থাকত না। এজন্য সরকার ও বিজিএমইএকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
নিহতদের স্মরণ
ট্র্যাজেডির একাদশ বার্ষিকী উপলক্ষে পরিত্যক্ত কারখানাটির সামনে ফুল দিয়ে নিহত শ্রমিকদের শ্রদ্ধা জানিয়েছেন স্বজন, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন।
শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) সকাল থেকে নিশ্চিন্তপুর এলাকার কারখানাটির সামনে নিহত শ্রমিকদের স্বজনরা ফুল হাতে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
পরে পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগ, ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কাস, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ফুল দিয়ে নিহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।