প্রতারণার অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের মে মাসে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৫) সদস্যরা নাটোরের লালপুর উপজেলা থেকে প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের কথা স্বীকার করে। র্যাব-৫ তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর স্থানীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
লালপুর উপজেলায় এ ধরনের কয়েক ডজন গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। হ্যাকিংকে সহজ আয়ের উৎস হিসেবে বেছে নিয়ে তারা গড়ে তুলেছে অঢেল সম্পদ। ইমো হ্যাকিং এবং ব্ল্যাকমেইলিং যেন এই এলাকায় এখন “ওপেন সিক্রেট” হয়ে উঠেছে। প্রতারক চক্রের হোতারা এলাকার কিশোর ও তরুণদের যুক্ত করে তাদের প্রতারণার নেটওর্য়াক ক্রমেই প্রসারিত করে চলেছে৷
লালপুর উপজেলার অনেক গ্রামের পুরুষ, বিশেষ করে বিলাইমারী ইউনিয়নের পুরুষরা এ বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ছোট দলে কাজ করে সহজেই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ তাদের কাছে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
প্রতারকদের অনেকেই নারী কণ্ঠে কথা বলায় দক্ষ হয়ে উঠেছে। মোবাইল ফোনে নারী কণ্ঠে কথা বলে তারা টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা নিজেদের পরিচিত কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়। আস্থা তৈরির জন্য তারা টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলে।
তথ্য বলছে, গত তিন বছরে এই উপজেলার বিভিন্ন বয়সী প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি এই ধরনের প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অন্তত ৫০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অনেক সময় ভুক্তভোগীরা মৌখিক অভিযোগ করলেও লোকলজ্জার কারণে মামলা করতে চান না। তবে পুলিশ মামলা করে, কিন্তু হ্যাকাররা জামিন পেয়ে আবারও একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। জেল থেকে বের হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিতে তারা আরও প্রভাবশালী ও দক্ষ হয়ে ওঠে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেসবুক, টেলিগ্রাম এবং মোবাইল ব্যাকিং পরিষেবা হ্যাক এবং ব্ল্যাকমেইলিং করে চাঁদাবাজি করাটা যেন আজকাল সাইবার অপরাধীদের কাছে সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
যেভাবে ফাঁদে ফেলে প্রতারকরা
সাধারণত, প্রথমে একজন প্রতারক ফেসবুকে নারীর ছবি ও নাম ব্যবহার করে আইডি খুলে প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরপর বিভিন্ন উপায়ে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে এবং একটি ভালো সম্পর্ক তৈরি করে। একপর্যায়ে প্রতারক প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে তার ইমো নম্বর চেয়ে নেয়।
যেহেতু বেশিরভাগ প্রবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইমো ব্যবহার করে, তাই প্রতারকরা ভিডিও কলের প্রলোভন দেখিয়ে টার্গেট ব্যক্তির কাছে ইমো নম্বর চায়।
এরপর প্রতারক চক্রের একজন সহযোগী টার্গেট ব্যক্তির ইমো নম্বর ব্যবহার করে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করে। এরপর কৌশলে সংগ্রহ করা হয় ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি)। অ্যাকাউন্ট আয়ত্তে আসার পরই পরিবর্তন করে ফেলা হয় পাসওয়ার্ড।
এরপর প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রিয়জনদের কাছে টার্গেট ব্যক্তির পাঠানো ও প্রাপ্ত কল এবং মেসেজ মেসেজ পর্যবেক্ষণ শুরু করে। তারপর বিভিন্ন অজুহাতে তার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের ফোন করে টাকা দাবি করে।
এক্ষেত্রে, তারা কখনও কখনও টার্গেটের কণ্ঠস্বর নকল করে, কখনও কখনও তার নিকটজনের কণ্ঠস্বর নকল করে, আবার কখনও গোপন তথ্য ছড়িয়ে ভাইরাল করার হুমকি দিয়েও আদায় করা হয় অর্থ।
পুলিশের পদক্ষেপ কি যথেষ্ট?
লালপুর উপজেলার বিলমারিয়ার কলেজ ছাত্র বিজয় ও রাজমিস্ত্রি কিরণ মোবাইল ফোনে ইমো হ্যাকিংয়ে দক্ষ। তারা পাশের গ্রামের একটি হ্যাকার গ্যাংয়ের সহায়তায় এই পথে পা বাড়ায়। প্রবাসী বাংলাদেশি ও তাদের পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা।
সম্প্রতি তাদের এমন প্রতারণার শিকার হন মেহেরপুরের শ্যামপুর গ্রামের নাজমুল নামে এক সৌদি প্রবাসী।
ইমো নম্বর হ্যাক করার পর প্রতারকরা তার স্ত্রী মাহাবুবাকে মেসেজ পাঠিয়ে জানায় যে তার স্বামীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তার মুক্তির জন্য অবিলম্বে তিন লাখ টাকা প্রয়োজন। টাকা পাঠানোর পর সে জানতে পারে সবই ভুয়া, নাজমুল সেই সময় কাজে ছিল। এরপর মাহাবুবার অভিযোগের ভিত্তিতে বিজয় ও কিরণকে আটক করে গোয়েন্দারা।
তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, “প্রতারকরা টাকা পাঠানোর জন্য আমাকে একের পর এক ফোন নম্বর দিতে থাকে। আমি ৩ লাখ ১২ হাজার টাকা পাঠানোর পর আমার স্বামী আমাকে ফোন করে এবং আমি জানতে পারি যে তারা তার ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেছে।”
বিলাইমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিদ্দিক আলী মিষ্টু বলেন, “ইমো হ্যাকাররা গোপনে কাজ করে। আমি তাদের কার্যকলাপে বিরক্ত। মাদকসেবী, বেকার যুবক ও কিছু ছাত্র-ছাত্রী এসব গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত। এটা এখন এই এলাকায় সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।”
প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “প্রতারকরা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে এসব কাজ করে এবং দায়মুক্তি পায়। এটি এখন একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।”
লালপুর থানার উপ-পরিদর্শক রেজাউল বলেন, “হ্যাকাররা খুবই সতর্ক। তবে যখনই আমাদের কাছে কোনো আসে, আমরা অভিযান পরিচালনা করি এবং তাদের গ্রেপ্তার করি।”
লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানান, তারা এসব ইমো প্রতারকদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন।
তিনি জানান, ২০২৩ সালে পুলিশ ১৮ জন এবং এ বছর একজন প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়া র্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীও বিভিন্ন সময়ে ইমো হ্যাকারদের গ্রেপ্তার করেছে।
জেলা প্রশাসক আবু নাসের ভূঁইয়া বলেন, “এটি সাইবার ক্রাইম। আমরা আইনের প্রয়োগ ও জনসচেতনতার মাধ্যমে এই অপরাধ বন্ধ করার চেষ্টা করছি।”