ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উঁচু জোয়ারের চাপে বরগুনা জেলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ২টি আমতলী উপজেলার তিনটি ও পাথরঘাটা উপজেলার ১৫টি গ্রাম রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানি বেড়ে দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ। ফলে, দুর্ভোগে পড়েছেন এসব গ্রামের বাসিন্দারা।
জানা গেছে, আমতলী উপজেলার আড়পাংগাশিয়া ইউনিয়নের পশরবুনিয়া এলাকায় তিনটি ও সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের ডালভাঙ্গা এলাকায় দুটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া পাথরঘাটায় জোয়ারের পানিতে প্রায় ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন হাজারো মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, বরগুনার ৮০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে নলটোনা, পালের বালিয়াতলী, কালমেঘা, রামনা এবং কালিকাবাড়ী নামক পাঁচটি জায়গায় প্রায় এক কিলোমিটার বাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
পরিকল্পিত আর টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় প্রতিবছরই ভাঙনের কবলে পড়তে হয় উপকূলবাসীর। বন্যার কথা শুনলেই আশ্রয় নিতে হয় আশ্রয়কেন্দ্রে।
বরগুনা ডিসি কার্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী মিলনায়তনে শনিবার অনুষ্ঠিত জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভায় বলা হয়েছে, জেলায় ৬৪২টি আশ্রয়কেন্দ্র, তিনটি মুজিব কিল্লা প্রস্তত রাখা হয়েছে। যেখানে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৫১০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। জেলার ছয়টি উপজেলায় ছয়টি কন্ট্রোল রুম এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটিসহ সাতটি কন্ট্রোল রুম সার্বক্ষণিক খোলা রাখা হয়েছে।
সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের ডালভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, “নদীর তীরে আমার বাড়ি। হাওয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে আমাদের এখানে উত্তর ডালভাঙ্গা এবং মাছখালি গ্রাম তলিয়ে গেছে।”
পশরবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা আফজাল সিকদার বলেন, “আগে থেকেই আমাদের এখানকার বেড়িবাঁধটির অবস্থা নাজুক। রিমালের প্রভাবে বৃষ্টির হওয়ায় বাঁধ ভিজে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে জোয়ারের পানির চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। সরকারি স্কুলে যাচ্ছি রাত কাটানোর জন্য।”
মাছখালী গ্রামের বাসিন্দা রুবেল হোসেন বলেন, “দিনে জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় রাতের জোয়ার নিয়ে আমরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। কারণ রাতে যখন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে, তখন পানি আরও বাড়তে পারে। আমাদের এখানে আশ্রয়কেন্দ্রও নেই। তাই আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি।”
এ বিষয়ে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব বলেন, “আগে থেকেই বরগুনার পাঁচটি স্থান থেকে দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেই ভেঙে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত করব।”
পাউবোর এই নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমাল ও পূর্ণিমার প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের চাপে বিষখালি ও বলেশ্বর নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে, জোয়ারের সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও পানি না কমায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। স্বল্প উচ্চতার রিং বাঁধের কারণে এসব এলাকায় পানি ঢুকে পড়ছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। বসতবাড়ি ও চুলা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার কারণে রান্না করতে পারেননি বাসিন্দারা।
পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের জিনতলা এলাকার বাসিন্দা মো. বেলায়েত হোসেন জানান, তার এলাকায় জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধের বাইরে দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দি রয়েছেন। জোয়ারের পানিতে এসব পরিবার রান্না পর্যন্ত করতে পারেননি।
সদর ইউনিয়নের হাড়িটানা এলাকার বাসিন্দা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের এই এলাকায় রিং বাঁধ বলতে কিছু নেই। বেশি উচ্চতার জোয়ারে খালের পানি বেড়ে যাওয়ায় আমাদের এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। প্লাবিত হওয়ায় এসব এলাকার কয়েক শতাধিক মানুষের ঘরে আজ রান্না হবে না।”
অতিরিক্ত জোয়ারের কারণে বরগুনার বাইনচটকি, বড়ইতলা ও পুরাকাটা ফেরিঘাটের সংযোগ সড়কসহ গ্যাংওয়ে তলিয়ে যাওয়ায় ফেরি চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
বিষখালি নদীর তীরবর্তী স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সাধারণত জোয়ারের পর পানি কমে যায়। কিন্তু সকালের আসা জোয়ারের পানি দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও কমছে না। নদী ফুলে রয়েছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে কিছু একটা হতে চলেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিষখালি নদীর তীরবর্তী হরিণঘাটা ও জিনতলা এলাকার শতাধিক ঘর বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা বেড়িবাঁধের ওপরে অবস্থান নিয়েছেন।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব বলেন, “নদীতে পানির অতিরিক্ত চাপ থাকায় পানি কমতে সময় লাগছে। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব বাঁধ ভেঙে গেলে তাৎক্ষণিক মেরামতের জন্য ৮০০ জিও ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।”
এদিকে বরগুনার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলার জন্য ৪২২ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য, শিশু খাদ্যের জন্য ১০ লাখ এবং গোখাদ্যের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। গঠন করা হয়েছে ৪৯টি মেডিকেল টিম এবং ৩৭ লাখ নগদ অর্থ প্রস্তুত রয়েছে।
এছাড়া স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন ৯,৬১৫ জন। যারা ঘূর্ণিঝড় পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করবেন। খোলা হয়েছে ১০টি কন্ট্রোল রুম। এছাড়া পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট রয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার।
ঘূর্ণিঝড় রিমালে আতঙ্কিত হয়ে উপকূলীয় জেলা বরগুনার চরাঞ্চলের প্রায় ৫০,০০০ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। কেন্দ্রগুলোতে রবিবার (২৬ মে) সকাল থেকে বিভিন্ন চরের নিম্নাঞ্চলের মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষের জন্য খাবার পানি, মুড়ি, চিড়া, বিছানা, কম্বল এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অনেক চরের বাসিন্দারা আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি।
তবে দুর্গম চরাঞ্চলের যেসব বাসিন্দারা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করতে অপরাগতা প্রকাশ করছেন, তাদের অতি দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান অথবা নিরাপদ স্থানে থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন বরগুনা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুহা. রফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আমরা সার্বক্ষণিক নজরদারি রেখেছি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে মাইকিং করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এছাড়া জেলার পায়রা-বিষখালী নদীতে ১৪টি খেয়া পারাপার বন্ধ করা হচ্ছে।”