ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বছরের পর বছর ধরে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়ে আসছে বাংলাদেশ। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি এসব ঝড় কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য মানুষের প্রাণ।
বছর ঘুরে প্রতিবারই এপ্রিল, মে, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে কোনো না কোনো ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসলীলা চলেছে। একবিংশ শতকে হতাহতের পরিমাণ অনেকটা কমলেও কমানো সম্ভব হয়নি সম্পদ ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি।
দেশের উপকূল স্পর্শ করে বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরের উত্তরাংশ অনেকটা ফানেল-আকৃতির। ফলে স্থলভাগের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে রূপ নেয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়গুলো। আর এই বিভীষিকার ভুক্তভোগী লাখ লাখ মানুষ। চলুন, স্মরণকালে বাংলাদেশে আঘাত হানা ভয়াবহ ১০ ঘূর্ণিঝড়ের সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন, ১৮৭৬
১৮৭৬ সালের ২৭ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরের গভীরে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপ ২৯ অক্টোবর নাগাদ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ৩০ অক্টোবর আরও প্রবল হয়ে তা উত্তর বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হয়। ঘূর্ণিঝড়ের আশপাশে সেসময় বাতাসের গতি উঠেছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২০ কিলোমিটার।
ওই ঘূর্ণিঝড় থেকে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পানির উচ্চতা ছিল ১২.২ মিটার। আর এই মাত্রা অব্যাহত রেখেই ৩১ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড়টি আছড়ে পড়ে বরিশালের ব্যাকেরগঞ্জ উপজেলার ওপর। পাশাপাশি আঘাত হানে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিসহ ব্রিটিশ ভারতের উপকূল বরাবর, যেটি বর্তমানে বরিশালে মেঘনা নদীর মোহনার কাছাকাছি একটি স্থান।
ঘূর্ণিঝড়টির আঘাতে সেবার হতাহতের সংখ্যা হয়েছিল প্রায় ২ লাখ মানুষ, যাদের অর্ধেকই মারা গিয়েছিল জলোচ্ছ্বাসে। এছাড়াও ঘরবাড়িসহ সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে ১ নভেম্বর থামে ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু এরপর আরও অনেক মানুষ মারা যায় ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে।
চট্টগ্রাম সাইক্লোন, ১৮৯৭
কুতুবদিয়া দ্বীপের কাছাকাছি এলাকায় এই ঘূর্ণিঝড়টি আছড়ে পড়ে ১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মিলে ওই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হতাহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৪ হাজারে। ঝড়-পরবর্তী সময়ে কলেরা মহামারিতে আরও ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
খুলনার ঘূর্ণিঝড়, ১৯৬১
১৯৬১ সালের ৯ মে সংঘটিত হওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল বাগেরহাট ও খুলনার বেশকিছু অঞ্চল। ঝড়ো হাওয়ার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার, আর জলোচ্ছ্বাসে ঢেউয়ের উচ্চতা পৌঁছেছিল ২.৪৪ থেকে ৩.০৫ মিটারে।
ঝড়ে ১১ হাজার ৪৬৮ জন নিহতের অধিকাংশই ছিল চর আলেকজান্ডারের অধিবাসী। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া গবাদি পশুর সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে বিশেষ করে নোয়াখালী ও হরিনারায়ণপুরের মধ্যকার রেলপথটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চট্টগ্রামের ঘূর্ণিঝড়, ১৯৬৩
১৯৬৩ সালের ২৮ থেকে ২৯ মে-র মধ্যে সংঘটিত এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টাপ্রতি ২০৩ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসে পানির উচ্চতা ৪.৩ থেকে ৫.২ মিটারে পৌঁছেছিল।
এই দুর্যোগ বিধ্বস্ত করে দেয় সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী দ্বীপসহ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলকে।
এতে মারা যায় ১১ হাজার ৫২০ জন মানুষ ও ৩২ হাজার ৬১৭ গবাদি পশু। এছাড়াও ধ্বংস হয় ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৩৩২টি ঘরবাড়ি, ৪ হাজার ৭৮৭টি নৌকা এবং খেতের ফসল।
বরিশালের ঘূর্ণিঝড়, ১৯৬৫
বাকেরগঞ্জ ও বরিশালের এই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়টি সংঘটিত হয় ১৯৬৫ সালের ১১ থেকে ১২ মে-র মধ্যে। বাতাসের গতির সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার আর জলোচ্ছ্বাস অগ্রসর হয়েছিল ৩.৭ মিটার উচ্চতার ঢেউ নিয়ে। এই তাণ্ডবলীলায় মারা যায় ১৯ হাজার ২৭৯ মানুষ।
ভোলার সাইক্লোন, ১৯৭০
বিংশ শতকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি হয়েছিল ১৯৭০ সালের ৭ থেকে ১৩ নভেম্বর। ১০ নভেম্বর এটি ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার গতিবেগ অর্জন করে পরের দিন বিকেলে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলে প্রবেশ করে। বন্দরে ঘূর্ণিঝড়টির প্রবেশস্থলে ঝড়ো বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ ১০.৬ মিটার উচ্চতায় উঠেছিল।
ভোলা সাইক্লোনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া ও পটুয়াখালী। এছাড়াও তলিয়ে যায় চর বুরহানউদ্দিনের উত্তরে চর তজুমদ্দিন এবং মাইজদীর দক্ষিণে হরিণঘাটা।
সরকারি হিসাব মতে, সাইক্লোনে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫ লাখ। এছাড়া ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল প্রায় ২০ হাজার মাছ ধরার নৌকা, ৪ লাখেরও বেশি ঘরবাড়ি এবং ৩,৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে আরও ছিল দশ লাখেরও বেশি গবাদি পশু ও ফসলাদি।
চট্টগ্রামের ঘূর্ণিঝড়, ১৯৮৫
কক্সবাজার, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে সংঘটিত এই ঘূর্ণিঝড়ের স্থায়ীত্বকাল ছিল ১৯৮৫ সালের ২৪ ও ২৫ মে। ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল উপকূলবর্তী অঞ্চল সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও উড়িরচর।
চট্টগ্রাম অতিক্রমের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৪ কিলোমিটার। এই দমকা হাওয়া সন্দ্বীপে ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার ও কক্সবাজারে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারে নেমে যায়।
জলোচ্ছ্বাসে পানির উচ্চতা ৩.৪ দশমিক ৬ মিটারে পৌঁছে গিয়েছিল। এই দুর্যোগে হতাহতের সংখ্যা দাড়িয়েছিল ১১,০৬৯ জন মানুষ এবং ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৩টি গবাদি পশু। সেইসঙ্গে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ৯৪,৩৭৯টি ঘরবাড়ি এবং ৭৪ কিলোমিটার রাস্তা ও বাঁধ।
বাংলাদেশ সাইক্লোন, ১৯৮৮
১৯৮৮ সালের ২১ নভেম্বর মালাক্কা প্রণালীর মধ্যে নিম্নচাপ থেকে উদ্ভূত হয় এই ঘূর্ণিঝড়। ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে আছড়ে পড়ার সময় ঘণ্টায় ২০১ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে সর্বোচ্চ তীব্রতায় পৌঁছে।
স্থলভাগের ওপর দিয়ে জলোচ্ছ্বাসের দানবীয় আগ্রাসনে পানির উচ্চতা ছিল ২ মিটার। এই তীব্রতার শিকার হয় বাগেরহাট, বরগুনা, ভোলা, যশোর, খুলনা, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা এবং সুন্দরবনের একাংশ।
এর ফলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫,৭০৮ জনে, যাদের অধিকাংশের মৃত্যু ঘটে খুলনা জেলায়। এদের অনেকেরই মৃত্যু হয় বিদ্যুতের খুঁটি বসতবাড়ির ওপর ধসে পড়ার কারণে বা সরাসরি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে।
শক্তিশালী এই ঝড়ের দাপটে প্রায় ২ লাখ টন ফসল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সারাদেশে ৫০ হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়; সেইসঙ্গে গৃহহীন হয়ে পড়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ।
রাজধানী ঢাকায় ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বাতাসের কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং যান চলাচলে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। একইসঙ্গে শহরজুড়ে বন্যা দেখা দেয়। দেশজুড়ে ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অবশেষে ৩০ নভেম্বর দুর্বল হয়ে পড়ে ৮৮’র সাইক্লোন।
বাংলাদেশ সাইক্লোন, ১৯৯১
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াল সাইক্লোন ঘটেছিল ১৯৯১ সালের ২৪ এপ্রিল। বঙ্গোপসাগরের গভীরে বৃহৎ এলাকা নিয়ে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড়টি ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের উপকূলে প্রবেশ করে। চট্টগ্রাম জেলার স্থলভাগের ওপর ঘূর্ণি বাতাসের গতি ওঠে ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটারে।
ঘূর্ণিঝড়টি থেকে ৬.১ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সমগ্র উপকূলরেখাকে প্লাবিত করে ফেলে। এর ঘটনায় নিহত হয় অন্তত ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ জন। শুধু বাঁশখালীতেই নিহতের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার এবং কুতুবদিয়া উপজেলায় ২০ হাজারেরও বেশি। কিছু ছোট ছোট দ্বীপ একদম জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছিল।
গোটা উপজেলার ৮০ থেকে ৯০% বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছিল এবং সমস্ত গবাদি পশু মারা গিয়েছিল। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় এবং গৃহহীন হয়ে পড়ে ১ কোটি মানুষ। গ্রামের পর গ্রাম লন্ডভন্ড করে দিয়ে অবশেষে ৩০ এপ্রিল ঝড়ের অবসান ঘটে।
বিপর্যয়ের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের সমন্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে অপারেশন সি এঞ্জেল পরিচালনা করা হয়। এটি বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক ত্রাণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি।
ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৭
২১ শতকের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়টির নাম “সিডর” যার মেয়াদকাল ছিল ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত। উত্তর ভারত মহাসাগরের ঘূর্ণিঝড়ের নাম প্রণয়নের বিধি জারির পর এটি ছিল চতুর্থ নামযুক্ত ঝড়।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এই ঝড় খুব কম সময়ে ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগে পৌঁছে দানবীয় আকার ধারণ করে। ৫ মিটারের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি জেলার পুরো শহর। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুন্দরবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তথ্যানুসারে, সিডরে প্রাণহানির সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়ায়। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা।