১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরপর পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করলেও চুক্তির বিরোধিতা করে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠন করা হয়। এরপরই ফের শুরু হয় পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তার ও রক্তের খেলা। এবার লড়াই জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ’র।
ইউপিডিএফ গঠনের বছর দুয়েক পর নানিয়ারচর থেকে তিন বিদেশিকে অপহরণ করা হয়। প্রায় এক মাস পর মুক্তিপণের মাধ্যমে তাদের ছাড়া হয়। সেই থেকে শুরু পাহাড়ে অপহরণের রাজনীতি। পাশাপাশি ইউপিডিএফ-জেএসএস’র মধ্যে এলাকা নিয়ন্ত্রণের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায় হাজারখানেক নেতাকর্মী প্রাণ হারায়।
২০০৭ সালে জনসংহতি সমিতিতে ফাটল ধরে। তখন সেখান থেকে বেরিয়ে ২০১০ সালে তাতিন্দ্রলাল চাকমা পেলে, সুধাসিন্ধু খীসা, শক্তিমান চাকমাকে মিলে গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা) নামে নতুন রাজনৈতিক দল। যেহেতু দলটি সন্তু লারমার কাছ থেকে সরে গিয়েই গঠিত হয়েছে, সেই হিসেবে ইউপিডিএফ’র পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সখ্যতা গড়ে ওঠে তাদের।
এরই মধ্যে ২০১৭ সালে আবার প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ’র বিদ্রোহী একটি অংশ তপনজ্যোতি চাকমা বর্মার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে পৃথক আরেকটি দল গঠন করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ’র (গণতান্ত্রিক) তৈরি হয় নয়া মেরুকরণ। পূর্বে হিসাব-নিকাশ উল্টে গিয়ে এবার ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জনসংহতি সমিতি এক হয়ে যায়। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের দুই শত্রু জনসংহতি সমিতি (সন্তু লারমা) ও ইউপিডিএফ ভেতরে ভেতরে অনেকটা সন্ধি হয়। যদিও প্রকাশ্যে তারা বিষয়টি অস্বীকার করে।
ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠনের পর গত মার্চ মাসে ইউপিডিএফ’র সহযোগী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই শীর্ষ নেত্রীকে অপহরণ করার অভিযোগ ওঠে তপনজ্যোতি চাকমা বর্মার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ’র (গণতান্ত্রিক) ওপর। প্রায় ৩২ দিন পর এই দুই নেত্রী মুক্তি পেলেও এই ঘটনায় তপনজ্যোতি চাকমা বর্মার ওপর চরম ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে ইউপিডিএফ। এছাড়া প্রায় সাতজনের মতো ইউপিডিএফ’র নেতাকর্মী খুন হন। এসব খুনের ঘটনায় ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দোষারোপ করা হয়।
একপর্যায়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকে থাকার লড়াইয়ে দয়াসোনা চাকমা ও মন্টি চাকমার অপহরণ মামলার দুই প্রধান আসামি অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা ও তপনজ্যোতি চাকমাকে হত্যা করা হয়। এতে ফের অশান্ত হয়ে ওঠে পাহাড়।
পাহাড়ের এসব হত্যাকাণ্ডে সাধারণত পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয় না। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করলেও এখনও পর্যন্ত তার কোনও সুরাহা পাওয়া যায়নি।
গত ৩ ও ৪ মে রাঙামাটির নানিয়ারচরে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ছয় খুনের ঘটনায় দুটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ১১৮ জনের নাম উল্লেখ করে নানিয়ারচর থানায় অভিযোগ দুটি দায়ের করেন নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার দেহরক্ষী রুপম চাকমা ও ইউপিডিএফ’র (গণতান্ত্রিক) পক্ষ থেকে অর্চিন চাকমা। ইউপিডিএফ’র (গণতান্ত্রিক)পক্ষ থেকে দায়ের করা অভিযোগে ৭২ জনকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) পক্ষ থেকে ৪৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর মুখপাত্র নিরন চাকমা বলেন, ‘গত ৩ ও ৪ মে’র ঘটনার সঙ্গে আমাদের দলের কোনও সম্পৃক্ততা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা তাদের সৃষ্টি করেছে, আবার তাদের প্রয়োজনে তাদের হত্যা করতে পারে বলে মনে হচ্ছে। ইউপিডিএফ বার বার বলে আসছিল ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিকের কারণে পাহাড়ে হত্যার রাজনীতি শুরু হয়েছে।’
ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর দফতর সম্পাদক লিটন চাকমা বলেন, ‘ইউপিডিএফের হাতেই নিহত হয়েছে শক্তিমান চাকমা ও তপনজ্যোতি চাকমা। হত্যার রাজনীতির মাধ্যমে ইউপিডিএফ পাহাড়ে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।’
পার্বত্য সম অধিকার আন্দোলর রাঙামাটি জেলার আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম (মুন্না) বলেন, ‘তাদের মূল বিষয় ছিল জুম্ম জাতির অধিকার আন্দোলনের কিন্তু তারা সেখান থেকে সরে গিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণ এবং উপজেলাগুলোতে আধিপত্যের লড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা যত বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণে থাকবে তাদের তত বেশি চাঁদা, আপহরণ এবং বিশেষ করে নির্বাচন এলে তাদের মূল্য বেড়ে যায় নির্বাচনি প্রার্থীদের কাছে। যদি পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র চালান বন্ধ করা যায় এবং অবৈধ অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয় তাহলে এই সবুজ পাহাড় শান্তির পাহাড়ে রূপ নেবে। আর কোনও মায়ের কোল খালি হবে না।’
রাঙামাটির স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক ও রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক বলেন, ‘মূলত পাহাড়ে এখন যে সংঘাত হচ্ছে এটি আধিপত্যের লড়াইয়ের সংঘাত। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে একটার পর একটা সংগঠনের জন্ম হয়েছে এবং সংগঠনগুলো বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্যের বিস্তারের জন্য মূলত এই সংঘাত। পাহাড়ে এখন যে সংঘাত চলছে এর মূল কারণ হলো চাঁদাবাজি ও এলাকা নিয়ন্ত্রণ।’