পোষ্য কোটা ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ ও শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারী ঐক্য পরিষদ চায় পোষ্য কোটা বহাল রাখতে। অন্যদিকে পোষ্য কোটায় ভর্তি পুরোপুরি বাতিলের দাবিতে সোচ্চার শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে আজ মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন দুপক্ষই।
যেভাবে ঘটনার শুরু
গত রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে অনশন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন শিক্ষার্থী। প্রশাসনের আশ্বাসে ওই দিন দিবাগত রাতে অনশন ভাঙলেও পরদিন আবারও অনশন শুরু হয়। পরে গতকাল সোমবার দিবাগত রাত ১টার দিকে পোষ্য কোটা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত জানায় প্রশাসন।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে প্রতিবছর ৪০টি আসনে পোষ্য কোটায় শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে। পোষ্য কোটায় ভর্তি হতে হলে অন্তত ৪০% নম্বর পেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিজীবীর সন্তানদের ক্ষেত্রে এই কোটা প্রযোজ্য হবে। একজন চাকরিজীবী একবারই পোষ্য কোটা ব্যবহার করতে পারবেন।
তবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আজ বেলা ১১টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা মিছিল নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে যান। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি, পূর্বের নিয়মেই পোষ্য কোটায় ভর্তি নিতে হবে। পরে পোষ্য কোটাসংক্রান্ত সব শর্ত বাতিল ও ফের বহালের দাবিতে আগামীকাল থেকে লাগাতার কর্মবিরতির ঘোষণা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ।
এদিকে, এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, পোষ্য কোটা বাতিলসংক্রান্ত পোস্টার কর্মচারীরা ছিঁড়ে ফেলেন। এর প্রতিবাদ জানাতে গেলে এক শিক্ষার্থীকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ধাক্কা দেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, এ ঘোষণার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরাসরি ইন্ধন রয়েছে।
একপর্যায়ে দুপুর আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। এসময় তারা পোষ্য কোটা পুরোপুরি বাতিলের দাবি করেন।বিক্ষোভে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়।
এরপর বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে যান এবং দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে কর্মচারীরা তাদের কর্মসূচি শেষ না করে চলে যান। পরে শতাধিক শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে প্রশাসনিক ভবনের মধ্যে আটকে পড়েন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যা বলছেন
শিক্ষার্থীরা বলছেন, “পোষ্য কোটা মানেই অযোগ্যদের সুযোগ করে দেওয়া। পোষ্য কোটা নিয়ে গতকাল প্রশাসন সংস্কারের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। কিন্তু আমরা তা প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বে পোষ্য কোটা পুরোপুরি বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি।” দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নিবিড় ভূইয়া বলেন, “অযৌক্তিক পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে আমরা অবস্থান নিয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী কারোরই পোষ্য কোটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অজপাড়াগাঁয়ের একজন কৃষকের সন্তান যদি মেধার ভিত্তিতে জাহাঙ্গীরনগরে পড়াশোনা করতে পারে, তাহলে একজন শিক্ষার্থী যে জাহাঙ্গীরনগরের ছোট থেকে বড় হয়েছে, ভালো স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছে তার কোনো ধরনের প্রিভিলেজ লাগবে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মেজবাহুল হক বলেন, “আমাদের একমাত্র দাবি অযৌক্তিক পোষ্য কোটা সম্পূর্ণ বাতিল। এই কোটার ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না। যারা এই কোটার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তাদের থেকে একরকম পৈতৃক উত্তরাধিকার আর চাই না। আমরা নতুন করে এসব পৈতৃক উত্তরাধিকার দেখতে চাই না। পোষ্য কোটা সম্পূর্ণ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আমরা রেজিস্ট্রার বিল্ডিং ছাড়ব না।”
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আলী চিশতি বলেন, “পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে আমরা গতকাল অনশন করেছি। আজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোটা বহালের দাবিতে প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে আমাদের পোস্টারগুলো ছিঁড়ে ফেলেন। আমি বাধা দিতে গেলে তারা আমাকে ধাক্কা দেন। আমি এ প্রশাসনের কাছে এ ঘটনার বিচার চাই।”
কর্মকর্তা - কর্মচারীরা যা বলছেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা - কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি আব্দুর রহমান বাবুল বলেন, “পোষ্য কোটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধাকে ব্যাহত করে না। পোষ্য কোটা একটি প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা যেটা ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই এই সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে। এটা আমাদের অধিকার।”
তিনি আরও বলেন, “পোষ্য কোটার জন্য নতুন যে নিয়ম করা হয়েছে সেগুলো বাতিল করে পূর্বের সব সুযোগ-সুবিধা পুনর্বহালের জন্য আমরা সকালে প্রতিবাদ মিছিল করেছি। আগামীকাল থেকে যত দিন পর্যন্ত পূর্বের সুযোগ-সুবিধা পুনর্বহাল করা না হবে তত দিন পর্যন্ত আমাদের লাগাতার কর্মবিরতি চলবে।”
প্রশাসন যা বলছে
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, “পোষ্য কোটার কিছু সংস্কার করা হয়েছে, আমরা আলোচনা করছি। সব পক্ষের দাবির মধ্যে সমঝোতা আনতে আলোচনা হবে। আমরা ইতোমধ্যে পোষ্য কোটার সংস্কার করেছি। এ বিষয়ে আমরা একটা কমিটিও করেছি। এখানে সব পক্ষেরই দাবি আছে। আমরা ছাত্র শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলের বিষয় যেন যৌক্তিক পর্যায়ে আসে আমরা এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করব। আমরা সব পক্ষকে সহযোগী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”
এর আগে, সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পোষ্য কোটায় কিছু পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এক শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগ মিলে সর্বোচ্চ ৪০ জন পোষ্য কোটা সুবিধা পাবেন। ভর্তির জন্য পাস নম্বর ৪০% (৩২ নম্বর) নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, সন্তান ও দত্তক নেওয়া সন্তানের ক্ষেত্রে এই সুবিধা প্রযোজ্য থাকলেও এখন শুধুমাত্র সন্তানরাই এই সুবিধা পাবেন। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের চাকরি জীবনে একবারই এই সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন। যদি তাদের একাধিক সন্তান থাকে, তাহলে কেবল একজন এই সুবিধা পাবে। কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী যে বিভাগে কর্মরত, সেই বিভাগে তার সন্তান ভর্তি হতে পারবে না।