Thursday, March 20, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

নেত্রকোনায় নদী-পুকুরে সাকার মাছ, আতংকে মাছ চাষিরা

সর্বগ্রাসী সাকার মাছের কারণে দেশীয় প্রজাতির অনেক ছোট মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে

আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৫, ০৪:০৩ পিএম

নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন নদী, জলাশয় ও পুকুরে মিলছে সর্বগ্রাসী সাকার মাছ। উদ্ভট রং আর আকৃতির এ মাছ দেখতে উৎসুক জনতা আগ্রহ দেখালেও চিন্তিত স্থানীয় মাছ চাষিরা। জেলার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে স্থানীয় মাছ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি এ জেলায় আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে সাকার মাছের বৃদ্ধি। ঠিক কোথা থেকে কিভাবে এ মাছ এ জেলায় এলো তা জানা নেই কারও।

মাছ চাষিরা জানান, এসব  মাছ তাদের পুকুরে আসার পর থেকে বিভিন্ন দেশীয় ছোট ছোট মাছের বংশ বৃদ্ধি একেবারেই কমে গিয়েছে। অনেক মাছ ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

জেলার সদর উপজেলার উলুয়াটি গ্রামের মাছ চাষি ও তরুণ কৃষক আরিফুর রহমান জানান, তাদের পুকুরে এ মাছের পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলেছে। কয়েকদিন পরপর জাল দিয়ে এ মাছ তুলে মেরে ফেললেও এর পরিমাণ কমছে না। এদিকে সাকার মাছের বিচরণের কারণে দেশীয় চিংড়ি, পুঁটি, বাইলা মাছসহ অনেক ছোট ছোট মাছ হারিয়ে যাচ্ছে পুকুর থেকে।

জানা যায়, সাকার মাছ একটি সর্বগ্রাসী মাছ। এই মাছটি একবার কোনো জলাশয়ে ঢুকে পড়লে এর বিস্তার রোধ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। চাষের পুকুরে এই মাছ ঢুকে পড়লে অন্য মাছের সঙ্গে খাবার ও বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। এতে করে বাইরে থেকে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছের উৎপাদন পাওয়া যায় না।

সাকার মাছ জলজ পোকামাকড় ও শেওলার  পাশাপাশি ছোট মাছ এবং মাছের পোনা খেয়ে থাকে। পাখনা খুব ধারালো হওয়ায় এ মাছের সঙ্গে লড়াই করার সময় ধারালো পাখনার আঘাতে অন্য মাছের দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয় এবং পরবর্তীতে পচন ধরে সেগুলো মারা যায়। এ মাছ রাক্ষুসে প্রজাতির না হলেও প্রচুর পরিমাণে খায়। এতে খাদ্যের যোগান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয় অন্য মাছের সঙ্গে। বেশিরভাগ সময়ই দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে জলাশয় থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। জেলায় সাকার মাছ এমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় মাছ চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজাহান কবীর বলেন, “সম্প্রতি জেলায় বিভিন্ন স্থানে এ মাছের দেখা মিলেছে এবং তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এ মাছ অনেক প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। এ মাছ জেলার হাওর ও নদীতে ছড়িয়ে গেলে তা এ অঞ্চলের মাছের বংশবৃদ্ধিতে এবং প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।”

তিনি আরও জানান, এ মাছের উপদ্রব থেকে দেশীয় মাছের বংশবৃদ্ধি রক্ষায় দেখামাত্রই এ মাছ মেরে ফেলতে হবে। বা কেটে তা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।

জানা গেছে, এ মাছের পুরো নাম “সাকার মাউথ ক্যাটফিশ”। অনেকে “সাকার ফিশ” নামে চেনে। বৈজ্ঞানিক নাম “হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস”। নেত্রকোনায় স্থানীয়রা একে “টাইগার ফিশ” নামেও চেনেন।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াটিক স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, এ মাছ  মূলত দক্ষিণ আমেরিকার মাছের একটি প্রজাতি যা এখন দক্ষিণ এশিয়ার জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের জলাধার ও নদীতে সাকার মাছের আধিক্য বেড়েছে। এ ছাড়া এটি উত্তর আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ছে।

এ পর্যন্ত এ মাছের দুটি ধরন পাওয়া গেছে। একটির রং সাদা ও ছোপ ছোপ দাগ। অপরটি কালো এবং তার উপর সাদা ডোরাকাটা দাগ। বর্তমানে বাংলাদেশের নদ-নদীতে দ্বিতীয়টি ব্যাপকভাবে পাওয়া যাচ্ছে। এটি সাধারণ একুরিয়ামের জন্য আদর্শ মাছ। এই মাছ ময়লাসহ অন্যান্য মাছের খাদ্য খেয়ে থাকে এবং দ্রুত বংশবিস্তার করে থাকে। তাই যেখানে এই মাছ বেশি পরিমাণে থাকে সেখানে অন্যান্য মাছ কম থাকে। বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদীসহ প্রায় জলাশয়েই মাছটি উল্লেখযোগ্য আকারে দেখা যায়।

মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সাকার ফিস উন্মুক্ত জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ায় দেশীয় অনেক প্রজাতির মাছ খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে। এটি চিংড়ি, কালি বাউশ, মাগুর ও শিং মাছসহ ছোট শামুক জাতীয় শক্ত খোলের প্রাণী খেয়ে সাবাড় করে ফেলে।

সাকার মাছ দেশের জন্য ক্ষতিকর বলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালিয়ে আসছে মৎস্য অধিদপ্তর। তাদের এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, সাকার ফিশ আশির দশকে ব্রাজিল থেকে অননুমোদিতভাবে বাহারি মাছ হিসেবে প্রথম বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।

অ্যাকুয়ারিয়ামের কাচে যে শ্যাওলা জমে, তা খেয়ে পরিষ্কার রাখে সাকার ফিশ। এ কারণে অ্যাকুয়ারিয়ামে এই মাছ রাখা হয়। ধারণা করা হয়, বিদেশ থেকে আনা এই মাছ কোনোভাবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

সাকার ফিশ নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুরে চাষ করা মাছের সঙ্গে ব্যাপকভাবে ধরা পড়ছে, যা জীববৈচিত্র্য এবং দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। ২০২৩ সালে সরকার সাকার ফিশের আমদানি, প্রজনন, চাষ, পরিবহন, বিক্রি, গ্রহণ বা প্রদান, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করে।

   

About

Popular Links

x