রাজধানী ঢাকার মিরপুরের পল্লবীতে “পেপার সানি” নামে পরিচিত রাকিবুল হাসান সানি (৩২) হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী। একাধিক সূত্র বলছে, দীর্ঘদিনের মাদক কারবারের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বই তার মৃত্যুর প্রধান কারণ। তবে নিহতের পরিবারের দাবি, সানি এলাকায় কিশোর গ্যাং ও মাদকচক্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাকে খুন করা হয়েছে।
নিহত সানি কালশীর মোহাম্মদ সোহেলের ছেলে। স্ত্রী ও মা-বাবাসহ পরিবারের সঙ্গে মিরপুরের পল্লবী এলাকায় বসবাস করতেন তিনি।
তিনি ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা ও অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন বলে দাবি করছেন তর পরিবার।
মাদক কারবার ও পুরোনো দ্বন্দ্ব
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, সানি ও তার এক সময়কার ঘনিষ্ঠ রুবেল গ্রুপের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা ও এলাকায় আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ গ্রুপের সদস্যরা হলেন— কুখ্যাত ল্যাংড়া রুবেল, বোমা কাল্লু, টানা আকাশ, জিন্দা ও কাসরা সোহেলসহ আরও অনেকে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এরা সবাই কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত এবং পল্লবী এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, সানি মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
তার বাবা ইউএনবিকে বলেন, “আমার ছেলে এলাকার কিশোর গ্যাং ও মাদক চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতো। এটাই তার অপরাধ। এজন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে।”
রহস্যময় রাত ও হত্যাকাণ্ডের চিত্র
মামলার এজাহার অনুযায়ী, হত্যার আগের রাতে সোমবার (৯ জুন) সানিকে স্বপন নামে এক যুবক মিরপুর সাড়ে ১১ এলাকায় ফোন করে আড্ডা দেওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। রাত ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেও আর ফেরেননি তিনি। পরদিন মঙ্গলবার মিরপুর ১১ এলাকার বি ব্লকের ৩ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর বাসার সামনে একটি ফাঁকা জায়গায় সানির লাশ পাওয়া যায়।
স্থানীয়রা জানান, হাতকড়া ও গামছা দিয়ে বাঁধা অবস্থায় লাশটি পড়ে ছিল। সানির মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন খোয়া যায় বলে এজাহারে বলা হয়।
পরিবারের অভিযোগ, তাকে সকাল ৬টার দিকে হাতকড়া পরিয়ে, দুই পা বেঁধে গলা কাটা হয়।
রুবেল গ্রুপের অন্ধকার জগৎ
সূত্র জানায়, রুবেল আগে পেশায় রিকশাচালক ছিলেন। পরে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে সে। এক সময় সানি ও রুবেল একসঙ্গে কাজ করলেও পরবর্তীতে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এলাকাবাসী জানায়, বোমা কাল্লু সম্প্রতি জামিনে বের হয়ে এসেছে এবং এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাকে ব্যবহার করা হয়েছে।
ঘটনার আগের দিন সোমবার রুবেল একটি প্রাইভেটকারে করে বোমা কাল্লুকে মিরপুর ১১ এলাকার বাংলা স্কুলের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন ফাজজু নামে আরেকজন মাদক ব্যবসায়ী। এরপর এলাকায় আধাঘণ্টা ধরে শোডাউন করে তারা। পরদিনই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
আইনি প্রক্রিয়া ও পুলিশের অবস্থান
ঘটনার পর নিহতের মা রোজিনা বেগম বাদী হয়ে মঙ্গলবার পল্লবী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ল্যাংড়া রুবেল, বোমা কাল্লু, স্বপন, জিন্দা ও টানা আকাশের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল আলম ইউএনবিকে বলেন, “আসামিদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।”
ওসি আরও বলেন, “পেপার সানিকে তার প্রতিপক্ষ মাদক ব্যবসায়ী গ্রুপ হত্যা করেছে। এটি দুই পক্ষের মাদক নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্বের জেরে ঘটেছে। নিহত সানির বিরুদ্ধেও থানায় ৮ থেকে ৯টি মামলা ছিল।”
নিরাপত্তাহীনতায় এলাকাবাসী
গত ১০ মাস ধরে পল্লবী এলাকার বাসিন্দারা রুবেল গ্রুপের তাণ্ডবে অতিষ্ট। স্থানীয়দের ভাষ্য, এই গ্রুপের সদস্যরা একের পর এক অপরাধ করলেও, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। পেপার সানির মতো কেউ প্রতিবাদ করলেই তার করুণ পরিণতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ওই এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “এখানে এখন আইনের শাসন নেই। কেবল আছে কিশোর গ্যাং ও মাদক সন্ত্রাস। আমাদের প্রতিদিনই আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। আজ সানিতে হত্যা করা হয়েছে, কাল হয়তো আরেকজনকে করা হবে।”