দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যে ‘উপযুক্তকরণ’ খুব একটা প্রচলিত নয়। ‘উপযুক্তকরণ’ বললেই আমরা একজন শ্বেতাঙ্গ লেখকের লেখায় ক্ষুদ্রজনগোষ্ঠীর অবহেলাপূর্ণ প্রতিরুপায়নকে বুঝি। কিন্তু, সমাজের উচ্চবিত্তের দ্বারা নিম্নবিত্তের হেনস্থা বা সবলদের দ্বারা দুর্বলদের উপর অবিচারকে ‘উপযুক্তকরণ’ বলে সম্বোধন করা হয়না।
ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৮-তে “অ্যাপ্রোপ্রিয়েট কালচার” শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় কথা হয় ইতিহাস ও মুক্তচিন্তা নিয়ে। ইতিহাসবিদ সামিয়া খাতুন এই প্যানেলের সঞ্চালনা করেন। প্যানেল সদস্য হিসেবে ছিলেন তিনজন ভারতীয় লেখক– অ্যানি জাইদি, জয়শ্রী মিস্রা এবং হিমাঞ্জলী সংকর। এই তিনজনের লেখাতেই ক্ষমতার প্রকৃতি, উৎস, অভিব্যক্তি উঠে এসেছে। সঞ্চালক সামিয়া খাতুন বললেন, “ক্ষমতা সাধারণত যাদের হাতেই থাকে তারা নিজেদের মতো করে গল্প বানায় এবং কিভাবে তা উপস্থাপিত হবে তাও নিয়ন্ত্রণ করে। আর এসব হয় প্রায়শই লিঙ্গীয় ‘উপযুক্তকরণে’র মাধ্যমে”।
সামিয়া খাতুন প্রথম প্রশ্ন করেন হিমাঞ্জলী শঙ্করকে। তাঁর কাছে জানাতে চাওয়া হয় কিশোর-কিশোরী দের এবং শিশুদের লেখায় লিঙ্গ বৈষম্য কতোটা প্রকট সে বিষয়ে। কারণ হিমাঞ্জলী সংকর নিজেই একজন লেখক এবং প্রকাশক এবং তার এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর উত্তর কিছুটা ভালোলাগা এনে দেওয়ার মতো। তিনি বলেন, “ভারতে নতুন হলেও শিশুদের লেখার লিঙ্গ বৈষম্য করা হয়না”। তবে, তিনি বলেন, অনেকের মধ্যে আবার এই ধরণের লেখাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রবনতাও দেখা যায়। সেশনের সঞ্চালক শঙ্করের উপন্যাসের প্রশংসা করে বলেন, ‘মিসেস. সি রিমেম্বার্স’ একজন আলজাইমার রোগী নারী, তিনি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা দেখিয়ে জানান দেন নিজের অবস্থানের। লেখক স্বীকার করেন, তার উপন্যাসে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে অপরিহার্যতা না দেওয়ার ব্যাপারটা স্বেচ্ছায় করা হয়েছে।
ক্ষমতার আরেক উৎস হলো ঐতিহাসিক সত্যকে মিথ্যা গল্প দিয়ে পরিবর্তন করা। এখানে প্রশ্ন আসে একজন লেখককে কতটা চিন্তার স্বাধীনতা দেওয়া উচিৎ। এরকম অপ্রত্যাশিত এক অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল জয়শ্রী মিশ্রা কে। তাঁর উপন্যাস ‘রাণী’ উত্তর প্রদেশের রাজ্য সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাই। রাজ্য সরকার মিশ্রাকে ইতিহাস বিকৃতির দায়ে অভিযুক্ত করে। তবে লেখক বলেন, “রাণী লক্ষ্মী বাই কে তিনি একজন মানুষের মতো মানবিক চরিত্র হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, একটি সামরিক চরিত্র হিসেবে নয়”।
এক পর্যায়ে সেন্সরশিপ এবং রাষ্ট্রীয় নজড়দারির বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। অ্যানি জাইদির মঞ্চনাটক ‘আনটাইটেলড-১’ জর্জ অরওয়েলের ডিস্টোপিয়া মনে করিয়ে দেয়। একজন ব্যক্তি কিছু বলতে গেলে কতটা স্বাধীনতা উপভোগ করবে এবং তার ফলাফল কি দাঁড়াবে – সে বিষয়েই মূলত এই নাটক। নাট্যকারের মতে, “যারা মুক্ত পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা চর্চা করে, তারা সবচেয়ে বড় বিপদে আছে কেননা তারা যেহেতু কোনো নিউজ এজেন্সিতে কাজ করেনা, তাই তাঁদের বিপদে কেউ রক্ষাও করতে আসবেনা।“
প্যানেলের সবাই মোটামুটি একমত হন, বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রই হলো সেই ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান যার চাওয়া বা না চাওয়ার উপর রাষ্ট্রের নাগরিকের স্বাধীনতা নির্ভর করে।