২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৮০ ভাগ রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে
২০১৯-২০ অর্থ বছরের প্রথম ছয়মাসে হিমায়িত চিংড়ি থেকে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রথম ছয়মাসে সে আয় কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। এই সময়ে ক্রয় আদেশ বাতিল হওয়ায় রপ্তনিকারকদের লোকসান হয়েছে ৪৬২ কোটি টাকা। ফলে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সাদা সোনাখ্যাত চিংড়ির ভবিষ্যত।
চলতি অর্থবছরে হিমায়ীত চিংড়ি থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বর্তমান পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলে যা অর্জন কঠিন বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণের কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার এ টি এম তৌফিক বলেন, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া হিমায়িত চিংড়ির ৮৫ ভাগ যায় ইউরোপে, আর ১৫ ভাগ আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে। তবে এসব দেশে করোনভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানায় এক প্রকার বন্ধ হয়ে পড়েছে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি। ফলে আর্থিক মন্দার শিকার হয়েছে দেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্যের এই খাত।
সী ফুড বায়িং এক্সপোট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক সুজন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বিশ্ব বাণিজ্য মন্থরতা পরিস্থিতিতে দ্রুততম সময়ে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৮০ ভাগ রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন- বিএফএফইএ সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানিকারকেদের লোকসান হয়েছে ৪৬২ কোটি টাকা।
চিংড়ি চাষের সাথে জড়িত কয়েকজন ঘের মালিকের সাথে আলাপকালে জানা যায়, পূর্বের বছরগুলোর তুলনায় এ বছর ঘেরের হারি বেশি। চিংড়ি পোনার দাম ঊর্ধ্বগতি, খাবারের দাম বেশি, ঘের প্রসেসিংয়ের জন্য মালামাল এবং শ্রমিকের দাম বেশি। কিন্তু মাছের দাম কম। আর তার জন্যই দিশেহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ চাষিরা। উৎপাদন খরচের তুলনায় বিক্রয় মূল্য কম হওয়াতে পথে বসতে শুরু করেছে অনেক চিংড়ি চাষি। সম্প্রতি করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব আসার পর থেকে ব্যাংক লোন ও এনজিও লোন বন্ধ থাকায় অনেকেই চিংড়ি চাষের খরচ এড়ানোর জন্য বিকল্প হিসেবে সাদা মাছের (কার্প জাতীয় মাছ) চাষ করেছেন। কিন্তু সেখানেও দরপত্তনের কারণে দিশেহারা সাদা মাছের চাষিরা।
মৎস্য আড়ৎ মালিক এবং কয়েকজন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীর সাথে আলাপকালে জানা যায়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এবং সিন্ডিকেটের কারণেও এমন দরপতন হতে পারে।
অভিযোগ রয়েছে, খুলনা বাগেরহাট অঞ্চলের কিছু ডিপো মালিক অধিক মুনাফার আশায় নিজের ডিপোতে বসে চিংড়ি চাষের হেডলেস প্রসেসিং করে থাকে। আর সে সময়ে মাছের ওজন বাড়ানোর জন্য পুশ করা হয় জেলি ও শিশা। এসব কারণে পূর্বে বহুবার রপ্তানি করা মাছ ফেরত পাঠানো হয়েছে বহির্বিশ্বের মার্কেট থেকে। সংকুচিত হয়েছে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা চিংড়ি মাছের বিশ্ব বাজার। আগের তুলনায় মাছের উৎপাদন অনেক বেশি। কিন্তু রপ্তানি কমেছে বহুগুণ। বিশ্ববাজারে চাহিদার তুলনায় বাংলাদেশ চিংড়ি উৎপাদন অনেক বেশি হওয়ায় এমন দরপতন হতে পারে বলেও তারা জানান।
ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিটলার গোলদার জানান, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ চিংড়ি মার্কেট ফলতিতা বাজার মুলঘর ইউনিয়নের ভেতরে। সে সুবাদে তিনি বিভিন্ন সময়ে মৎস্য মার্কেট পরিদর্শন করে থাকেন। এ বাজারে কোনো ব্যবসায়ীর অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে তিনি স্থানীয়ভাবে তা হস্তক্ষেপ করে সমাধান করে থাকেন এবং গুরুতর কোনো বিষয়ে তিনি প্রশাসনের সহায়তায় নিয়ে থাকেন। তবুও এখানকার কিছু ব্যবসায়ী গোপনে মাছে জেলি পুশ করে থাকেন বলে অনেকেই তার কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন না। এখানকার মৎস্যচাষিদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নত প্রশিক্ষণ, স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান,স্থানীয় প্রশাসনের সার্বক্ষণিক মার্কেট তদারকির মাধ্যমে এবং বহির্বিশ্বে অধিকভাবে বাজার সৃষ্টি করতে পারলেই আবারও সম্ভাবনা মিলবে চিংড়ি শিল্পের।
তিনি বলেন, এ অঞ্চলের মৎস্য আড়ৎগুলোতে রাস্তার উপর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কেনাবেচা হচ্ছে মাছ। এখানকার ডিপো মালিক এবং ব্যবসায়ীদের উপজেলা প্রশাসন থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও মানছেন না কোনো নীতিমালা। একদিকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কেনাবেচা হচ্ছে, তেমনি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি।
মতামত দিন