গাছে গাছে ঝুলছে আম, সেই সাথে দুলছে চাষির স্বপ্ন। ক'দিন পরেই আমপাড়ার ধুম পড়বে সাতক্ষীরায়। কিন্তু আম চাষির সেই স্বপ্নে আঘাত করেছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। ঝড়ের আতঙ্কে আমচাষির বুক দুরু দুরু করছে, সবার মনে একই প্রশ্ন- কতটা ক্ষতি হবে?
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এমনিতেই কোথাও পাঠাতে পারছেন না চাষি-ব্যবসায়ীরা। এমন সময় আরও দুঃসংবাদ নিয়ে এলো উপকূলে ধেয়ে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। এই খবর যেন তাদের কাছে “জ্বালার উপর পালার বাড়ি”।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে ৫ হাজার ২৯৯টি আম বাগানে আম চাষ হচ্ছে। ১৩ হাজার ৯৯ জন চাষি আম উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে আরও কয়েক হাজার আম চাষি রয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিক টন। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আম পাড়া শুরু হবে। তার আগেই পাকা আম বাজারে উঠতে শুরু করবে।
জানা যায়, গত সপ্তাহে সাতক্ষীরায় কালবৈশাখী ঝড়ে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে পড়া সেই কাঁচা আম ৫ থেকে ১৫ টাকা পাইকারি দরে এসব আম ক্রয় করে ট্রাকে ভরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়েছে পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
এদিকে ৩১ মে থেকে হিমসাগর আম বাজারজাতের সিদ্ধান্তের মধ্যে ঘূণিঝড় আম্ফানের খবরে শঙ্কা আর উৎকণ্ঠা ভর করছে সাতক্ষীরার আমচাষির মধ্যে। ঝড়ে আম পড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তারপর ঝড়ে যোগাযোগ ভেঙে পড়লে আম বাজারজাতের ব্যবস্থা করা না গেলে বিপুল লোকসানের মুখে পড়বেন চাষিরা।
জেলার প্রায় লক্ষাধিক পরিবার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আম চাষের সাথে যুক্ত। পরিবারিক আম চাষের পাশা-পাশি বাণিজ্যিকভাবে জেলায় আম চাষ হয়ে আসছে ঐতিহ্যগতভাবে। শুধুই তাই নয়, বর্তমান রাহধানীর বেশিরভাগ বাজারগুলিতে প্রধানত এই জেলার আম সরবরাহ হয়। ফলে এই জেলার অর্থনীতির অন্যতম উৎস হচ্ছে আম। হিমসাগর আম ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে রপ্তানি হয়ে আসছে গতকয়েক বছর ধরে।
সাতক্ষীরা সদরের আমচাষি বিপ্লব দাশ সুনা জানান, ১০টি বাগানে তার ১৫ বিঘা জমিতে ২০০-১৫০টি আম গাছ আছে। এসব আম বাগানের ইজারা ও পরিচর্যা করতে ঋণ নিয়ে খরচ করেছেন প্রায় তিন লাখ টাকা। এখনও পরিচর্যা করছেন। আশা করেছিলেন সাড়ে ছয় লাখ টাকার আম বিক্রি করতে পারবেন। কালবৈশাখি ঝড় ও করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এক প্রকার বন্ধ। বিদেশে আম রপ্তানি করতে পারবেন না। স্থানীয়ভাবে যা বিক্রি হবে তাতে এক লাখ টাকার বেশি উঠবে না, কিন্তু আম্ফানের খবরে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এই চাষি, ঝড়ে যদি সব আম পড়ে যায় তবে পথে বসে যেতে হবে তার।
কলারোয়ার একটি কলেজের শিক্ষক আরিফ মাহমুদ বলেন, এ বছর কলারোয়া থেকে ১০০ মেট্রিকটন হিমসাগর আম ইউরোপে রপ্তানির কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তা রপ্তানি করা যাচ্ছে না।
পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকার আম চাষি নূরুল আমিন বলেন, জেলার বাইরে ও বিদেশে আমের বাজার ধরতে না পারলে সবাই লোকসানে পড়বে। পরিস্থিতি দেখে আমি ১৭ বিঘার আম বাগান তিন লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছি। দুই সপ্তাহ পর থেকে আম উঠলে আর বাজার স্বাভাবিক থাকলে খুব সহজে তা ছয় লাখ টাকা বিক্রি করা যাবে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়লে তার বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হবে।
সাতক্ষীরা তালা উপজেলার খলিষখালি গ্রামের রহমান হোসেনের ২০ বিঘার আম বাগান আছে। খরচও হয়েছে অনেক। করোনাভাইরাসের কারণে আম বাজারজাত করা যাবে না বলে মনে করেছিলেন তিনি। তবে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলে তছনছ হয়ে যাবে তার স্বপ্ন।
সাতক্ষীরা সুলতানপুর কাঁচা-পাকা বাজার সমবায় সমিতির সভাপতি রাশেদ বলেন, “কালবৈশাখী ঝড় ও করোনায় আমের বেশ ক্ষতি হয়েছে। বাজার জাতকরণের কারণে দাম কম। আমচাষিদের পাশাপাশি আমারও আমের ন্যায্য দাম নিয়ে শঙ্কায় আছি।”
একই ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রওশনআলী জানান, “আমচাষি, খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা প্রণোদনার দাবি রাখে।”
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে চাষিদের অনলাইনে আম বিক্রি করতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া কালবৈশাখী ঝড়ে আমের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমস্যা হবে না। কিন্তু আম্ফানে কী পরিমাণ ক্ষতি হবে সেটা আগে থেকে বলা সম্ভব না।”
সাতক্ষীরা কৃষি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক নূরুল ইসলাম বলেন, “ঝড়ের আগে আমের ক্ষয়-ক্ষতি বিষয়টি বলা সম্ভব না। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে চাষিরা বিপুল টাকার লোকসানে পড়বেন।”