পর্যটন শিল্প বিকাশে কক্সবাজারকে আধুনিক শহর গড়ে তুলছে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলোর নির্মাণ কাজ শুরু হলেও শুরু হয়নি গণমানুষের দাবি গ্যাস লাইন সংযোগ। সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় গ্যাস সংযোগ থেকে বঞ্চিত রয়েছে জেলার ২৩ লাখ জনগোষ্টি।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ও পর্যটন রাজধানী নামে খ্যাত কক্সবাজারকে আধুনিক নগরী ও পর্যটন শিল্প বিকাশে বর্তমান সরকার নানামুখী উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সম্প্রসারণ নির্মাণ কাজ, মহেশখালী মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, টেকনাফ সাবরাং ও জাইল্যারদিয়ায় ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এগিয়ে চলেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে চার লেনের নির্মাণ কাজ। কিন্তু, কক্সবাজারের ২৩ লাখ মানুষের দীর্ঘদিনের গণদাবি গ্যাস লাইন সংযোগ প্রকল্পের কাজের কোনো সুখবর নেই। গ্যাস লাইন সংযোগের বিষয়ে সরকাররি বা বেসরকারিভাবে কোনো সংস্থা এ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অথচ কক্সবাজারের খুব সন্নিকটে সোনাদিয়া হয়ে এলএনজি গ্যাস সংযোগ চট্টগ্রামের আনোয়ারা হয়ে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হয়েছে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, “পর্যটন শিল্প বিকাশে কক্সবাজারে গ্যাস সংযোগের কোনো বিকল্প নেই। কক্সবাজারের সোনাদিয়া, মাতারবাড়ি হয়ে গ্যাসের যে টার্মিনাল সংযোগ চট্টগ্রামে চলে গেছে। তার সুফল যদি কক্সবাজারবাসী পেত,তাহলে পর্যটন শিল্প আরও ত্বরান্বিত হত। এছাড়াও সাধারণ মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে গ্যাস ব্যবহার সহজ হতো। আমরা চাই দ্রুত কক্সবাজারে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হোক।”
“আমরা কক্সবাজারবাসী সংগঠন”র সমন্বয়ক মো. কলিম উল্লাহ বলেন, “আমার জানামতে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় যে গ্যাসক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছে তা থেকে গ্যাস উত্তোলন করে জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হচ্ছে। একইভাবে বিদেশ থেকে জাহাজ করে গ্যাস আমদানি করে কক্সবাজারের সোনাদিয়া থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত সংযোগ স্থাপিত হয়েছে এবং জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। অথচ এত কাছে গ্যাস পেয়েও কক্সবাজারবাসী বঞ্চিত। আমি মনে করি কক্সবাজারের ২৩ লাখ মানুষের সাথে এক ধরনের বৈষম্য। এই বৈষম্য অবসানে দ্রুততম সময়ে কক্সবাজারে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হোক।”
কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ সড়ক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোখিম খান বলেন, “প্রতিবছর পর্যটন খাত থেকে লাখ লাখ টাকা সরকার রাজস্ব পেয়ে থাকে। গ্যাস সংযোগ স্থাপন হলে আমাদের অনেকাংশ খরচ কমে যেত। এখন আমাদের সিলিন্ডার ভর্তি গ্যাসের উপর নির্ভর করতে হয়। তাই, ঢাকা-চট্টগ্রামের মত কক্সবাজারে যদি গ্যাস সংযোগ স্থাপন করতে পর্যটন খাত থেকে আরও বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে।”
চানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, “কক্সবাজারে গ্যাস লাইন সংযোগের ব্যাপারে আপাতত কোনো কিছুই হয়নি। কোনো পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত গ্যাস সংযোগের দাবিও উঠেনি। তাই, সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে কিনা জানা নেই। ভবিষ্যতে যদি গ্যাস সংযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করব।”
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গত ২০১০ সালে সরকার ভাসমান এলএনজি গ্রাস আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ কক্সবাজারের মহেশখালীতে দেশের প্রথম ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে বহুজাতিক কম্পানি এস্ট্রা অয়েল অ্যান্ড এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে “টার্মিনাল ইউজ এগ্রিমেন্ট” ও ২০১৪ সালের ২৬ জুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করেছিল পেট্রোবাংলা। সমুদ্রে ভাসমান জাহাজ থেকে স্থলভাগে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আনা হবে।
চুক্তি অনুযায়ী বাণিজ্যিকভাবে এ টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরুর পর ১৫ বছর তা অব্যাহত থাকবে। টার্মিনাল নির্মাণ, গ্যাসের হুইলিং ও অন্যান্য খরচ হিসেবে এক্সিলারেট এনার্জিকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের জন্য পরিশোধ করতে হবে ৫৯ সেন্ট। ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল মাসে মহেশখালীর অদূরে বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়া দ্বীপের জিরো পয়েন্টে নোঙ্গর করেছিল এলএনজি বোঝাই ভাসমান টার্মিনাল “এক্সিলারেট” ও ৫টি পোর্ট সার্ভিস ভেসেল। সার্ভিস ভেসেলগুলোর মধ্যে একটি ব্যবহৃত হবে টার্মিনালের জ্বালানি পরিবহনে এবং অপর একটি টার্মিনালে নিয়োজিতদের আনা-নেওয়া এবং তাদের রসদ সরবরাহে নিয়োজিত থাকবে। অপর ৩টি টাগবোট থাকবে ভাসমান টার্মিনালের সঙ্গে। এগুলোই ভাসিয়ে রাখবে টার্মিনালকে।
ভাসমান টার্মিনালটি আসার সময় কাতার থেকে এলএনজির প্রথম চালানটি নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার ও কাতার সরকারের মধ্যে বছরে ২.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি সরবরাহের চুক্তি রয়েছে। এর উদ্বোধনী চালানটি নিয়ে মহেশখালীর কাছে বঙ্গোপসাগরে নোঙ্গর করেছিল এক্সিলারেট। সেখান থেকে আগস্টের ২য় সপ্তাহে পরীক্ষামূলকভাবে আনোয়ারা পর্যন্ত এবং ২০১৮ সালের গত ১৮ আগস্ট পাইপ লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে প্রতিমাসে এলএনজি নিয়ে জাহাজ এসে টার্মিনালে খালাস করে ফিরে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে এ ব্যাপারে ১৫ বছরের চুক্তি রয়েছে তাদের। দৈনিক ৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের ক্ষমতাসম্পন্ন এই টার্মিনাল তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ১৫৬ কোটি মার্কিন ডলার।
বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজারের মহেশখালী সোনাদিয়া চ্যানেল হয়ে ভাসমান জাহাজ থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় খালাস হচ্ছে এলএনজি গ্যাস। তাই, কক্সবাজারের এত কাছে হয়েও কক্সবাজারবাসি গ্যাস সংযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় ভাবিয়ে তুলেছে এতদাঞ্চলের মানুষকে। সব কিছু বিবেচনা করে খুব দ্রুত কক্সবাজারে গ্যাস সংযোগ স্থাপন করবে সরকার, এমনটাই প্রত্যাশা গ্যাস বঞ্চিত মানুষের।