সম্প্রতি ইউনিলিভার বাংলাদেশ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে দেশে বহুজাতিক কোম্পানির র্শীষস্থানীয় পদের অভিজাত তালিকায় দেশীয় কর্মী হিসেবে নাম লিখিয়েছেন জাভেদ আখতার।
একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানি এবং নামি ব্র্যান্ডগুলির র্শীষস্থানীয় পদ বিদেশি কর্মীদের দখলে থাকতো। কিন্তু ২০২১ সালের শুরুতে এসে একটু দেরিতে হলেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ বাংলাদেশিদের দখলে এসেছে, যারা বেশিরভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে স্নাতক ডিগ্রি শেষ করেছেন।
বর্তমানে দেশে বেশ কয়েকটি কোম্পানির নির্বাহী কর্মকর্তার পদ আইবিএ'র শিক্ষার্থীদের দখলে রয়েছে।
নামি প্রতিষ্ঠানগুলোর র্শীষস্থানীয় পদে দেশীয় কর্মকর্তা হিসেবে বর্তমানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মধ্যে ইউনিলিভার বাংলাদেশ-এর জাভেদ আখতার, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক-এর নাসের এজাজ বিজয়, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো-এর শেহজাদ মুনিম, রবি আজিয়াটা এর মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, এইচএসবিসি বাংলাদেশ-এর মো. মাহবুব উর রহমান, গ্রামীণফোন-এর ইয়াসির আজমান, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ-এর রুপালী চৌধুরী উল্লেখযোগ্য।
হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন (এইচএসবিসি), রবি আজিয়াটা লিমিটেড এবং গ্রামীণফোন-এর প্রধান নির্বাহীর পদে বিদেশিদের থাকার প্রথা থাকলেও এগুলোও এখন বাংলাদেশিদের দখলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহাদত হোসেন সিদ্দিকী এ প্রসঙ্গে বলেন, “বৈশ্বিক সংস্থা এবং কোম্পানির প্রধান নির্বাহী পদে বাংলাদেশি বিজনেস গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগপ্রাপ্তি নিঃসন্দেহে দারুণ একটি বিষয়।"
তিনি আরও বলেন, "তাদের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি বিষয়ের মিল আমরা দেখতে পাই। তাদের সবার বৈশ্বিক শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, যোগাযোগ, গ্রহণযোগ্যতা এবং নেটওয়ার্ক, স্থানীয় বাজার সম্পর্কে ধারণা রয়েছে।"
গুগল এবং মাইক্রোসফ্টের মত প্রতিষ্ঠানে ভারতীয়দের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানে অন্যদের তুলনায় আমাদের স্নাতকরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। আমাদের এই বিকাশকে টেকসই করতে আমাদের স্মার্ট, মেধাবি, এবং প্রযুক্তিসচেতন কর্মীদের ওপর নজর দিতে হবে, মেধার অপচয় রোধ করতে হবে।"
তিনি উল্লেখ করেন যে, বৈশ্বিক সংস্থাগুলো শুধু লাভের জন্যই স্থানীয় সিইও নিয়োগ দেয় না। এইসব মেধাবী কর্মীদের তাদের দেশের জন্য কাজ করার আগ্রহ থাকে এবং তারা সহজপ্রাপ্য।
বেতন কাঠামো তুলে ধরে অধ্যাপক সিদ্দিক তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, বিদেশে সিইও পদে একজন ২৫ লাখ টাকা উপার্জন করতে পারে, তবে যদি তিনি বাংলাদেশে ৫ লাখ টাকা উপার্জন করেন তবে তার ক্রয়সক্ষমতা কিন্তু প্রায় সমানই হবে।
“আমাদের ক্রয়সক্ষমতা অনেক দেশের তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ বেশি। সবাই নিজ আগ্রহে এটাকে বাড়াচ্ছে,“ বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ এর অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল মোমেন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “আইবিএ বিভাগে আমরা বিশ্বমানের নেতা সৃষ্টি করছি। আপনি বাংলাদেশে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় সিইও'দের দিকে তাকালে দেখবেন তারা কোনো না কোনোভাবে এই বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। আমাদের পাঠ্যক্রম আধুনিক। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমরা আমাদের পাঠ্যক্রমটি সাজিয়েছিলাম এবং সময়ের সাথে সাথে এটিকে হালনাগাদ করছি।”
“প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রচন্ড সম্ভাবনা আমাদের শিক্ষার্থীদের রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা, তাদের বৈচিত্র এবং পেশাদারিত্বও প্রশ্নাতীত। এবং তাদের প্রভাবও উল্লেখযোগ্য,“ বলেন অধ্যাপক মোমেন।
“আমরা আমাদের পাঠ্যক্রমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সংযুক্ত করছি। যাতে প্রতিষ্ঠানি তাদেরকে বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মত করে তৈরি করতে পারে," বলেন তিনি।
“বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে এগোচ্ছে, এবং আমাদের স্নাতকদের স্থানীয় বাজার সম্পর্কে ধারণা রয়েছে, এখানে এখন বিদেশি সিইও কম রয়েছে। এটা কোম্পানির লাভের বিষয়। এইসব স্নাতকদের নিজেদের প্রমাণ করার এবং কাংক্ষিত ফলাফল অর্জনের সুযোগ রয়েছে," বলেন তিনি।
দেশের প্রথম বাংলাদেশি সিইও সিটি ব্যাংকের মামুন রশীদ বলেন, মোহাম্মদ এ (রুমী) আলী, আতা সফদার, মামুন রশীদ, কামরান বকর, আবরার আনোয়ার, শেহজাদ মুনিম, নাসের এজাজ, রুপালী চৌধুরী, মাহতাব আহমেদ, ইয়াসির আজমান, মাহবুবুর রহমান অথবা জাভেদ আখতার প্রত্যেকের একটা গল্প আছে এবং তাদের বৈশিষ্ট্যে মিল রয়েছে।
তিনি বলেন, “আমাদের বয়স হচ্ছে। সিটি ব্যাংকে আমার এক সহকর্মী বললেন, আমি এখনও ব্যাংকিং খাতের একজন তরুণ সিইও। আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন দেখতে পাই আমার আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে আমার কর্মনিষ্ঠতা, ক্যাডেট কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ, আমার সহকর্মী, আমার সিনিয়র, আমার বাবা-মায়ের আর্শীবাদ সবকিছুরই অবদান ছিল।“
সময় দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে বলে জানান তিন।
“কিছু লোক আমাকে ঘৃণা করে-অর্থ এবং এই উপার্জন আমার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিছু লোক আমাকে পছন্দ করে- কারণ, আমি ব্র্যান্ড নির্মাতা। কেউ আমাকে এড়িয়ে চলেন- কারণ, আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কেউ আমাকে সম্মান করেন- কারণ, আমি কর্মনিষ্ঠ। সাফল্য অর্জনের সহজ কোনো উপায় আছে? সম্ভবত না," বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “স্থানীয়করণ, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিদেশি শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এইসব সিইওদের স্থানীয় বাজারে গ্রহণযোগ্যতা আছে, তারা স্থানীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে এবং তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে।"
“ক্রমবর্ধমান বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে আমাদের প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে, মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে,“ বলেন মামুন রশীদ।