ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের জের ধরে ইউরোপে যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে, তার নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ বাংলাদেশের নেই। বরং এই যুদ্ধ যত জোরদার ও দীর্ঘায়িত হবে, ততই বিপদের আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই বিপদ দু’দিক থেকে আসবে বলে মনে করছেন তারা। একটি হলো বাণিজ্যের দিক থেকে বা অর্থনৈতিকভাবে। এটিই বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে। আরেকটি ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে, যা তাৎক্ষণিক নয়, বরং সুদূরপ্রসারী কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ইউক্রেনের সঙ্গে আরও কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৪৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করেছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯৫%-ই হলো তৈরি পোশাক ও বস্ত্র সামগ্রী আর রাশিয়া থেকে আমদানির ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে সবজি ও তেল। একই সময়ে ইউক্রেন থেকে ৫১ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি করা হয়েছে ৩১ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের পণ্য। আমদানির বেশিরভাগই হলো সবজি।
তবে যুদ্ধের কারণে দুই দেশের সঙ্গে মোট ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য বাণিজ্যের পুরোটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। এমনিতেই যুদ্ধকালীন সময় বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়, বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তাতে করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্ততকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি ফজলুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, “যে চালানগুলো রাশিয়া অভিমুখে রয়েছে, সেগুলো ঠিকঠাক মতো পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হতে পারে, এমনকি বাধাগ্রস্তও হতে পারে। তবে পণ্য রপ্তানির বিপরীতে প্রাপ্য মূল্য পেতে আরও বেশি সমস্যা হতে পারে। আর নতুন করে রপ্তানির কার্যাদেশ কমে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। সব মিলিয়ে রাশিয়ায় ৬০ কোটি ডলারের বেশি বার্ষিক রপ্তানি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না৷ বরং প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তা বাড়ছে। আর রাশিয়ার যেসব ব্যাংক এখনো সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি বা কোনো নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি, সেসব ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা হলেও পশ্চিমা ব্যাংকগুলো বা করেসপনডেন্স ব্যাংকগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে পারে যা লেনদেনকে কঠিন বা ব্যয়বহুল এমনকি অনিশ্চিত করে তুলতে পারে।”
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান মনে করেন, ইউক্রেন সংকট থেকে প্রাথমিকভাবে আঘাতটা আসবে খাদ্যপণ্য, বিশেষত গম এবং জ্বালানি তেলে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “বিশ্ববাজারে গমের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন। চলমান সংঘাতের সঙ্গে রাশিয়ার ওপর আরোপিত পশ্চিমাদের বিধিনিষেধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের ও তেলের সরবরাহ কমে যাবে, বাড়বে দাম। তখন বাংলাদেশকেও বেশি দামে এগুলো কিনতে হবে, যা দেশের ভেতর মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।”
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) গত বছর নভেম্বর মাসে দেশের ভেতর জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে উচ্চ হারে, যা অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করেছে পরের মাসেই। এখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর ব্যারেল প্রতি ১১০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দাম যদি নেমে না আসে, তাহলে বিপিসি শিগগিরই আবার দাম বাড়াবে কি না তা আপাতত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু বাড়ালে মূল্যস্ফীতিও আরেক দফা বেড়ে যাবে, যা মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা আরও কমিয়ে দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে যে, চলতি অর্থবছর গড় মূল্যস্ফীতি ৬% ছাড়িয়ে যাবে। ৫.৩০%-এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার আটকে রাখা কঠিন হবে বলেও মন্তব্য করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ড. আবিদ আরও বলেন, “ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কিভাবে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ কার্যকর করবে, তার ওপর নির্ভর করবে তাদের বাণিজ্য নীতির কিছু সাময়িক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তন বাংলাদেশের ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা এখনই বোঝার কোনো উপায় নেই।”
তবে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)-এর উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ মনে করেন, যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের সামগ্রিক চাহিদা কমবে, কেননা, ইউরোপের জ্বালানি তেলের বড় উৎস হলো রাশিয়া।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ব্যাহত হলে ইউরোপকে বিকল্প উৎস থেকে বাড়তি দামে তেল কিনতে হবে। তাতে বিশ্ববাজারে তেলের দাম আরও বাড়বে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। তেলের পাশাপাশি খাদ্যশস্য, বিশেষত গমের সরবরাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, যা খাদ্যের দাম বাড়াবে। তেল ও খাদ্যের বাড়তি দাম মেটাতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল সংখ্যক মানুষ অন্যান্য ব্যয়ে কাটছাঁট করবে। তার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানিতে পড়তে পারে।
বাংলাদেশের মোট বিশ্ব বাণিজ্যের এক-পঞ্চমাংশ সম্পন্ন হয় ইইউভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে। আর ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৯০% হলো বস্ত্র ও তৈরি পোশাক।
মনজুর আহমেদও মনে করেন যে সুইফট থেকে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ রাশিয়ার সাথে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় অসম্ভব করে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্র আরও কঠিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে। তার মানে হলে, খুব কম দেশের পক্ষেই এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে পারবে৷ তা করতে গেলে সে দেশও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে।
এমতাবস্থায় রাশিয়ার অর্থায়নে চলমান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজে বাধা তৈরি হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন মনজুর আহমেদ৷ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে এক হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। আর এই ঋণের টাকা আসছে প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হয়ে৷ কেননা, বাংলাদেশ রুবলের বদলে ডলারে ঋণের অর্থ নিতে চেয়েছে।
কিন্তু সুইফট থেকে রাশিয়া আংশিক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও এই টাকা আর এভাবে আনা যাবে না। সেক্ষেত্র বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে।
অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই কারেন্সি সোয়াপ বা দুই দেশের মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন সম্পন্ন করার একটি রূপরেখার কথা ভাবা হচ্ছিল বলে জানা গেছে।
এই ব্যবস্থায় দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্ব স্ব দেশের রপ্তানিকারকদেরকে তাদের স্বদেশীয় মুদ্রায় পাওনা মিটিয়ে দেবে আর তিন মাস অন্তর হিসেব সমন্বয় করবে। তবে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পশ্চিমা দেশগুলো এখন যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা পাশ কাটিয়ে কারেন্সি সোয়াপ করে বাণিজ্য কতটা করা যাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
এদিকে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া ও বিমা মাশুল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে যেহেতু পণ্য রপ্তানির পুরোটাই এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) ভিত্তিতে করে থাকে, তাই এগুলো রপ্তানির খরচ বাড়াবে না। তবে আমদানির বেশিরভাগই সিএন্ডফিভিত্তিতে (কষ্ট অ্যান্ড ফ্রেই্ট) হওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ ভাড়া আমদানিকারকের খরচ বাড়াবে, যার প্রভাব পড়বে আমদানিকৃত পণ্যমূল্যে।
ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে, যা বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়াবে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাণিজ্য ঘাটতি এক হাজার ৫৬১ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬৮৭ কোটি ডলার। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বেড়ে ডলারের বিপরীতে টাকারে আরও দরপতন ঘটাতে পারে।
তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ছিল মাত্র ১৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার। ইউক্রেন থেকে কোনো এফডিআই ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পর আর আসেনি। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসেছিল মাত্র ১১ লাখ ৫০ ডলারের বিনিয়োগ। সে হিসেবে সরাসরি রুশ বিনিয়োগ নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দেবে না।